দাকোপ (খুলনা) প্রতিনিধি : খুলনার দাকোপে কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদন করে রওশন আরা বেগম এখন স্বাবলম্বী। এ সারকে ভার্মি কম্পোস্ট বলা হয়। ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করে ক্রমেই চাষিদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন তিনি। ইতি মধ্যে স্বল্প মূলধনের এ পদ্ধতি ছড়িয়ে দিয়েছেন অনেক মানুষের মাঝে। প্রতি মাসে এ সার বিক্রি তিনি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা উপার্জন করছেন।
সম্প্রতি উপজেলার জয়নগর এলাকায় রওশন আরার নিজ বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে একচালা টিনের ঘর। ওই ঘরের মধ্যে ২টি বড় পাকা হাউজে ও ঘরের মেঝেতে বানানো ১২টি মাটির চাড়ি (পাত্র) এবং অন্য একটি স্থানে টিনের ঘরে ১৫০টি রিং স্লাবে তিনি এ কেঁচো সার উৎপাদন করে থাকেন।
কোঁচো সার উৎপাদনে উপকরণ হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন গলা গাছ, কচুরিপনা ও গোবর। তার প্রতি চাড়িতে প্রায় ১৫ কেজি থেকে ২০ কেজি, আর হাউজে প্রায় ৫ মন এবং রিং স্লাবে ২ মন সার রাখা যায়। এছাড়া তার খামারে কেঁচোর বংশ বিস্তার হচ্ছে। ফলে বাহির থেকে কেঁচো সংগ্রহ করতে হয় না। ২০০৯ সালে রওশন আরা বেসরকারি এনজিও উল্লাসী সৃজনী সংঘ থেকে প্রশিক্ষণ নেন। এছাড়াও তিনি উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর ও বেসরকারি এনজিও জে.জে.এস থেকেও কেঁচো সার উৎপাদনের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ২০১১ সালে উল্লাসী সৃজনী সংঘের সহযোগিতায় তিনি প্রথমে অল্প পরিসরে কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। প্রথম দিকে একটু কষ্ট হলেও এখন ভালোই বিক্রি হচ্ছে এ সার। এছাড়া কিভাবে কেঁচো সার উৎপাদন করেন তা দেখতে বিভিন্ন স্থান থেকে তার এ খামারে লোকজন আসে। তাছাড়া বাজারে এখন রাসায়নিক সারের মান খুবই খারাপ। আবার দামও বেশি। সেখানে ভার্মি কম্পোষ্ট পুরোপুরি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে তৈরি একটি সার। এ সারের দামও কম। ভার্মি কম্পোস্ট এ জৈব সার কিনে কৃষকরা তাদের ক্ষেতে ব্যবহার করছেন। তাই স্থানীয় কৃষকদের মাঝে সারটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এতে করে ওই এলাকায় দিন দিন ফসলের ক্ষেতে রাসায়নিক সার ব্যবহারের প্রবণতা কমছে আর পরিবেশ বান্ধব কেঁচো সার ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রওশন আরা বেগম বলেন, প্রথমে গোবর সংগ্রহ করে তার সাথে কলা গাছ অথবা কচুরিপনা কুচিয়ে মিশিয়ে বস্তায় ভরে ৮ থেকে ১০ দিন রাখি। তারপর ওই গোবর চাড়িতে (পাত্র) রেখে কেঁচো দিই। কেঁচো আবার ছায়া বা অন্ধকার জায়গা পছন্দ করে। তাই চাড়িটি একটি বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখি। এভাবে ১ মাসের মধ্যে তৈরি হয় ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার। আমার খামারে এখনো প্রায় এক লাখ টাকার কেঁচো সার মজুদ রয়েছে। প্রতি কেজি সার খুচরা ২৫ টাকা আর পাইকারি ২০ টাকা বিক্রি করি। আর ১ কেজি কেঁচো ১৮০০ টাকায় বিক্রি করে থাকি। বর্তমানে আমার সংসার ভালোই চলছে। ভবিষ্যতে আমার খামারে আরো বেশি পরিমাণ কোঁচো সার উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি আমি বেসরকারি এনজিও জেজেএস এবং ব্রাকের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে কেঁচো সার তৈরির উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। ১ ঘন্টার প্রশিক্ষণে আমাকে ওই সংস্থা ১৫০০ টাকা করে সম্মানি দেন। এটা আমার কাছে ভালোই লাগে। আমি চাই নারীরা এ কাজে এগিয়ে আসুক। আমার মতো তারা খুব সহজেই কম পুঁজিতে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হোক।
জয়নগর এলাকার কৃষক কামাল গাজি জানান, আমার একটি সবজি খেত রয়েছে। আমি রওশন আরার খামার থেকে কেঁচোর সার কিনে সবজি খেতে দেই। এবার খেতে ফলন ভালোই হয়েছে। তাছাড়া এই সারটি প্রাকৃতিক একটা সার কোনো ভেজাল নেই দামও কম।
ব্রাকের কালি নগর শাখা ব্যবস্থাপক প্রশান্ত কুমার সরকার জানান, ব্রাকের আল্ট্রা পুওর কর্মসূচির আওতায় বিগত বছরে অতিদরিদ্র ৩০ জন সদস্যকে ভার্মি কম্পোস্ট দেওয়া হয়েছে। উক্ত সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্ম বিশ^াসী হিসাবে গড়ে তোলার পিছনে বড় অবদান রাখেছেন জয় নগর এলাকার সামাজিক শক্তি কমিটির সহ সভাপতি রওশন আরা বেগম।
এবিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ শফিকুল ইসলাম এ প্রতিবেদকে জানান, জৈব পদার্থ হলো মাটির প্রাণ। ক্রমেই মাটির প্রাণ হ্রাস পাচ্ছে তাই আমরা জৈব সার প্রয়োগের উপরে জোর দিচ্ছি। কেঁচো সারে ফলন ভালো হয় এটা প্রমাণিত। তাই আমরা চাষিদের সবজি খেতে ভার্মিক ম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে বলে থাকি। এছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে উঠান বৈঠকে কেঁচো সার উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে আসছি। বিশেষ করে মহিলাদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। তাছাড়া কমিউনিটি আকারে এ সার উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতি মধ্যে উপজেলার লাউডোব এলাকায় যাবতীয় উপকরণ, প্রশিক্ষণ ও কেঁচো দিয়ে পরিবেশ বান্ধব ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদনে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।