সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : কিছুদিন ধরেই প্রতি ভরি সোনার দাম দুই লাখ টাকার আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল। অবশেষে সেই মানসিক সীমা পেরিয়ে গেলÑবাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার, সোনার ভরি ছুঁয়েছে দুই লাখ টাকার উপরে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির ঘোষণায় জানা গেছে, বৃহস্পতিবার থেকে ২২ ক্যারেট সোনার ভরির দাম হবে ২ লাখ ৯ হাজার ১ শত ১ টাকা। স্বাধীনতার সময় যেখানে এক ভরি সোনার দাম ছিল মাত্র ১৭০ টাকা, সেখানে আজ বেড়েছে ১,১৮১ গুণ। এই খবর শুনে কেউ খুশি হন, কেউ বিমর্ষ। কারও চোখে ঝলমলে ধাতু, কারও মনে পোড়া বাস্তবতা। কারণ সোনার এই উত্থান আসলে সমাজের গভীর আর্থিক বৈষম্য, অনিশ্চয়তা আর কৃত্রিম জীবনযাত্রার প্রতীক।
স্বাধীনতার প্রথম দিকে সোনা ছিল আবেগের বিষয়। মা সিন্দুকে যতেœ রাখতেন দুটি কানের দুল, গলায় হালকা হার, আর মেয়ে জন্মালে একদিন তা তাঁরই হাতে তুলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সোনার অর্থ তখন ছিল ভালোবাসা, নিরাপত্তা আর সঞ্চয়।কিন্তু আজ? সোনা কেবল টাকার পরিমাপে মাপা হয়। “ভরি কতো?”Ñএই প্রশ্নই আজ আমাদের অর্থনৈতিক উদ্বেগের ভাষা। দুই লাখ টাকার ভরি শুনে এখন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর বুক ধকধক করে ওঠে। কারণ তাদের কাছে এটি শুধু ধাতুর দাম নয়, জীবনের খরচের আরেকটা বোঝা।
ঢাকার নবাবপুর, চট্টগ্রামের জুবলী রোড, খুলনার বড়বাজার, সাতক্ষীরার খান মার্কেটÑদেশের হাজারো সোনার কারিগরের জীবন আজ অনিশ্চয়তায় ভরা। তাদের আঙুলেই তৈরি হয় গলার হার, বালা, আংটিÑযেগুলোর চকচকে সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় ক্রেতা। কিন্তু এই কারিগরের হাতেই থাকে না সোনার একটি দানাও। দাম যত বাড়ছে, তত কমছে অর্ডার। দোকানমালিকরা গয়না তৈরি না করে পুরোনো গয়না গলিয়ে বিক্রির দিকে ঝুঁকছেন। এতে কারিগরের কাজ কমে যাচ্ছে। কেউ কেউ পেশা বদলে গেছেÑকেউ রিকশা চালাচ্ছেন, কেউ হোটেলে কাজ নিচ্ছেন।
একজন পুরোনো কারিগর বললেন, “সোনা তো এখন আগুন। আমরা আগুনে হাত দিই, কিন্তু পোড়াটা শুধু আমাদের গায়ে লাগে।” সোনার দাম যত বাড়ছে, তত কমছে তার কাজের সুযোগ। দোকানমালিকেরা এখন সোনার নতুন সেট তৈরি না করে পুরোনো গয়না রি-সাইকেল করছেন। ফলে সোনার কারিগরদের আয় দিন দিন কমছে। এক সময় যাদের হাতে জাতির শিল্প ছিল, এখন তারা পেট চালাতে অন্য পেশায় যাচ্ছেন।
কেউ ভ্যান চালাচ্ছেন, কেউ হোটেলে কাজ নিচ্ছেন। এই কারিগররা কখনোই সোনার মালিক হন নাÑতারা সোনার ছোঁয়া দেন, কিন্তু সেই সোনা তাদের জীবনে আলো আনে না। ধারণা করা হয়, সোনার দোকান মানেই ব্যবসার চূড়ান্ত লাভ। কিন্তু বাস্তবে এখন চিত্র উল্টো। আশাশুনির এক দোকান মালিক বলেন, “গ্রাহক নেই, বিক্রি নেই, কিন্তু খরচ তো কমে না। দোকানভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীর বেতন সব আগের মতোই।
এখন দিনে একটা চেইন বিক্রি হলেও ভাগ্য ভাল বলতে হয়।” দোকানমালিকদের সমস্যাটা দ্বিগুণ। একদিকে সোনার দাম বাড়ায় ক্রেতা কমছে, অন্যদিকে বিশ্ববাজারের ওঠানামায় প্রতিদিন নতুন দামের তালিকা বানাতে হয়। একদিনে হাজার টাকার তারতম্য মানে বিক্রিতে বিপর্যয়। ফলে অনেক দোকানমালিক এখন সোনার ব্যবসা গুটিয়ে অন্য খাতে বিনিয়োগ ভাবছেন। সোনার আলোয় ভরা দোকানের ভেতরেও এখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।
বাংলা সমাজে বিয়ের সঙ্গে সোনার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। একসময় কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা মেয়ের বিয়ের দিনটির কথা ভেবে সঞ্চয় করতেন মাসে মাসে। ধীরে ধীরে জমাতেন গয়নাÑএকজোড়া দুল, একটি চেইন, হয়তো একজোড়া বালা। যে পিতা ২০ বছর ধরে মেয়ের জন্য গোপনে এক ভরি সোনা জমিয়েছিলেন, আজ তার দাম শুনে চোখে পানি আসে। এখন এক ভরিতে দুই লাখ টাকাÑএই টাকায় হয়তো গ্রামের ছোট ঘর বানানো যায়, কিন্তু মেয়ের বিয়েতে সমাজের চোখে সেই “অলংকার” না থাকলে কেমন যেন অসম্পূর্ণ মনে হয়।
“মেয়ের গলায় হার পরানোর স্বপ্ন এখন ঋণের বোঝা হয়ে গেছে,”Ñবললেন সাতক্ষীরার কৃষক রমজান আলী। এই সমাজ এখনো সোনাকে মর্যাদার প্রতীক মনে করে। ফলে একেকটা বিয়ে মানে একেকটা অর্থনৈতিক চাপ। এক সময় যা ভালোবাসার উপহার ছিল, আজ তা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার গলার কাঁটা। সোনার দাম বেড়ে গেলে গ্রামের কৃষকের ঘরেও তার প্রতিধ্বনি পড়ে। কারণ তাঁদের ঘরেও একসময় ছোট্ট গয়না থাকতÑস্ত্রীর কানে দুল, মেয়ের হাতে চুড়ি। সেগুলো এখন বিক্রি করে দেন সংসার চালানোর প্রয়োজনে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বহু কৃষক এখন ধান ফলাতে পারছেন না, আবার বাজারে চালের দাম বাড়ছে। এই অবস্থায় অনেকেই বলেন, “গলায় সোনা থাকলে পেট চলে না।” একজন কৃষক যখন নিজের স্ত্রীর সোনার দুল বিক্রি করে ধানের বীজ কেনেন, তখন সোনার এই দাম আর কোনো অর্থনৈতিক উন্নতির প্রতীক থাকে না; এটি হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি। বাংলা পরিবারের গৃহিণী মানেই ছিল সিন্দুক বা আলমারিতে লুকানো কিছু সোনার গয়না।
সেটা ছিল সংসারের শেষ ভরসা। জরুরি প্রয়োজনে সেটি বিক্রি করে সংসার বাঁচানো যেত। আজ সেই সিন্দুক খালি। কারণ সোনার দাম এত বেড়েছে যে নতুন করে কিছু কেনার সাধও হারিয়ে গেছে। সাতক্ষীরার গৃহিণী দেবযানি বলেন, “আগে ভাবতাম পূজায় একটা দুল কিনব। এখন শুধু ভাবিÑচাল-তেলের দাম মেটাতে পারব তো?” গৃহিণীর চোখে সোনা এখন আর গর্ব নয়, বরং অস্পর্শযোগ্য স্বপ্ন।
অর্থনীতিতে একটি কথা আছেÑযখন বিশ্বে অনিশ্চয়তা বাড়ে, সোনার দামও বাড়ে। আজ বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর্থিক সংকট; তাই সোনার দামও ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই প্রভাব আরও তীব্র, কারণ ডলারের সংকট, বৈদেশিক রিজার্ভের চাপ ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি আমাদের বাজারে সরাসরি প্রভাব ফেলে। তবে প্রশ্ন হলোÑসোনার এই উত্থান আমাদের অর্থনীতির শক্তি, না দুর্বলতা? যখন গরিব কৃষক ধান বিক্রি করে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের দাম পান না, যখন গৃহিণী সংসার চালাতে হিমশিম খান, তখন সোনার দাম বাড়া মানে কেবল অর্থনীতির একদিক উজ্জ্বল হওয়া নয়, অন্য দিকের অন্ধকার আরও ঘন হওয়া।
সোনার বিজ্ঞাপনে এখনো হাস্যোজ্জ্বল মডেলরা গলায় ভারী হার পরে বলেÑ“নিজের মতো ঝলমল করি।” কিন্তু বাস্তবে, সেই ঝলমল জীবনযাপন করতে পারে গুটিকয়েক মানুষই। সমাজের এক প্রান্তে সোনার সেটের প্রদর্শনী, অন্য প্রান্তে এক টুকরো সোনার জন্য অগণিত শ্রমজীবী মানুষ দিনের পর দিন ঘাম ঝরাচ্ছেন। এই বৈষম্যই আজকের সমাজের মুখোশ খুলে দেয়। সোনা কেবল গয়না নয়Ñএটি এখন বিভেদের প্রতীক।
কেউ নিজের সুখ বোঝাতে গলায় সোনা ঝোলান, আর কেউ নিজের দুঃখে সেটি বিক্রি করে দেন। সোনার দাম বাড়ছে, কিন্তু মানুষের মান কমছে। অর্থনীতির সূচক বাড়ছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনের মান নিচে নেমে যাচ্ছে। একজন শ্রমিক সারাদিন রোদে ঘাম ঝরিয়ে যা আয় করেন, তাতে এক গ্রাম সোনাও কেনা যায় না। অথচ এই শ্রমিকের ঘামেই দাঁড়িয়ে আছে দেশের উৎপাদন, ব্যবসা, কৃষি।
সোনার দাম বাড়া অর্থনীতির বিষয় হলেও, এর ভেতরে আছে নৈতিকতার সংকট। আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে মানুষের গলার সোনার ওজন দিয়ে তার মান বিচার করা হয়। যেখানে মেয়ে জন্মালেই পিতা সঞ্চয়ের চিন্তা করেন, শিক্ষার নয়; অলংকারের চিন্তা করেন, দক্ষতার নয়। এই মানসিকতা বদলানো জরুরি। কারণ সমাজ যদি মূল্যবোধে ধনী না হয়, তবে সোনার পাহাড় গড়েও সুখী হওয়া যায় না।
একসময় “সোনার বাংলা গড়ব”Ñএই বাক্য ছিল আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। আজ “সোনার দাম বেড়েছে”Ñএই বাক্যই হয়ে উঠেছে শিরোনাম। এই দুই বাক্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে এক দেশের পরিবর্তন, এক জাতির সংকট।যে সোনা একদিন মায়ের সিন্দুকের গর্ব ছিল, আজ তা পিতার দায়, কারিগরের দুঃখ, গৃহিণীর কষ্ট আর কৃষকের অসহায়তার প্রতীক। তাই এই সময়ের প্রেক্ষাপটে সত্যিই বলতে হয়Ñঅলংকার এখন আর মানায় না।