ডেস্ক রিপোর্ট : ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি ফোটেনি। কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে বসে পোনা মাছ বেছে নিচ্ছেন প্রজা বর্মণ। পাশে ছোট বালতিতে দিনের উপার্জনের আশায় মাছ তুলছেন। তিনি বলেন, ‘যত সময় খাটা, তত সময় খাওয়া।
কাজ না করলে খাওয়া জোটে না।’ শরীরের ক্লান্তি সত্ত্বেও কাজ ছেড়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রজার পাশে ছিলেন স্বামী গোপাল বর্মণ। দুইজনের দৈনিক আয় গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা হলেও পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।
ছেলে চাকরি করেন যশোরে, কিন্তু সংসারের ভার এখনো বাবা-মায়ের কাঁধে।
গোপাল বর্মণের সাথে কথা বলে জানা যায়, একসময় তার পরিবারে ছিল ৮৪ বিঘা জমি, যা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন তারা বাঁধের পাশে অস্থায়ী ঘরে থাকেন। প্রতিদিন আতঙ্কে কাটে, কখন আবার মাটির এই ঠাঁইটুকু ভেসে যাবে।
খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার অন্তর্গত বেদকাশী, শাকবাড়িয়া, গাবুরা এই নামগুলো এখন নদীভাঙনের প্রতিশব্দ। ১৯৮৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত তিনবার নদীভাঙনে বাড়ি হারিয়েছেন ঠাকুরপদ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘একসময় বাড়ি ছিল এত বড়, এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে দৌড়াতে হতো। এখন সবই নদীতে।’ বর্তমানে বাঁধটিও ঝুঁকিপূর্ণ।
টেকসই বেড়িবাঁধ না হলে যেকোনো রাতে পুরো এলাকা পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। নিজে স্ট্রোকের রোগী, স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত, তারপরও জীবনযুদ্ধে থেমে নেই তারা।
শাকবাড়িয়ার কল্যাণীও প্রতিদিন এই লড়াইয়ের সৈনিক। ‘যখন মাছ পাই না, তখন অন্যের জমিতে কাজ করি’ , বললেন তিনি। দক্ষিণ বেদকাশীর রাজিয়া গাজি তার ভেসে আসা জীবন নিয়ে বলেন, নদীর সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে শিখেছি, কিন্তু এখন নদীই ঘরে ঢুকে পড়ে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে ২০২০ সালের আম্পান পর্যন্ত একের পর এক দুর্যোগে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে। আইলা ও আম্পানে শুধু খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলেই ৫০ হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়, হারায় ২৫ হাজার হেক্টর কৃষিজমি, যা লবণাক্ত হয়ে এখন চাষযোগ্য নয়। সাম্প্রতিককালেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ২০২৫ সালের ৭ অক্টোবর দাকোপের বটবুনিয়ায় রাতের আঁধারে আবারও ভেঙেছে বাঁধ। জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে ঘের ও ফসল। স্থানীয়রা বলছেন, বাঁধ আছে, কিন্তু টেকে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকল্পগুলোকে অনেকেই বলছেন আস্থাহীন। দুর্বল বাঁধ, তড়িঘড়ি মেরামত সব মিলিয়ে নদীর প্রবল স্রোতের সামনে দাঁড়ায় না কিছুই। পরিবেশকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, এই ধারায় চলতে থাকলে দক্ষিণ বেদকাশী একসময় বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হবে।
এ ছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবিকা মধু, মাছ, কাঁকড়া সংগ্রহ। কিন্তু তারা আরেক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখে ‘দাদন’ প্রথা। জেলেরা ঋণ নেন মালিক বা কোম্পানির কাছ থেকে, যারা বন বিভাগের অনুমতি ও প্রভাবশালী মহলের সহায়তায় জেলে নিয়ন্ত্রণ করে। জেলেরা তখন বাধ্য হন কম দামে তাদের কাছে মাছ বিক্রি করতে। ফলে ঋণ শোধ হয় না, বরং চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জেলে বলেন, ‘দাদনও এক ধরনের দুর্যোগ। আমরা মুক্তি চাই।’ এর পাশাপাশি নিষিদ্ধ সময়ে বিষ দিয়ে মাছ ধরার কারণে বনের প্রাণবৈচিত্র্য হুমকির মুখে।
দক্ষিণ বেদকাশির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. ওসমান গনি খোকন বলেন, ‘এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা যোগাযোগ। এলজিইডির কাজ বন্ধ। এনজিওরা কাজ করছে, কিন্তু চাহিদার তুলনায় কিছুই না।’ তার মতে দুর্যোগ প্রশমনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের
পাশাপাশি অন্যান্য সবার সমন্বিত উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই।