
বিশেষ প্রতিনিধি : পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চরে শুরু হয়েছে দেশের বৃহত্তম শুঁটকি আহরণ মৌসুম। দুর্যোগের ঝুঁকি, দস্যু আতঙ্ক আর ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে শুঁটকি উৎপাদনের আশায় ছুটেছেন জেলে ও বহদ্দাররা (মহাজন)।
দুবলা জেলেপল্লী বিশেষ টহল ফাঁড়ির আওতাধীন বঙ্গোপসাগরের পারের আলোরকোল, মাঝেরকিল্লা, অফিসকিল্লা, শ্যালার চর ও নারকেলবাড়িয়াসহ নির্ধারিত পাঁচটি চরে টানা পাঁচ মাস চলবে এই কর্মযজ্ঞ।
বনবিভাগের অনুমতিপত্র (পাস) নিয়ে রবিবার (২৬ অক্টোবর) সকাল থেকেই এসব চরে অস্থায়ী ঘর ও মাছ শুকানোর মাচা তৈরির কাজ শুরু করেছেন জেলে শ্রমিকরা। দু’এক দিনের মধ্যেই সম্পন্ন হবে এসব ঘর ও মাচা তৈরির কাজ। এরপরই শুঁটকি তৈরির জন্য সাগরে নামবেন জেলেরা।
প্রতিবছর ১ নভেম্বর থেকে মৌসুম শুরু হলেও এ বছর নির্ধারিত সময়ের অন্তত এক সপ্তাহ আগেই শুঁটকি উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে বনবিভাগ। আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত চলবে এই কার্যক্রম।
গত মৌসুমে কয়েক দফা দুর্যোগের কারণে সাগরে মাছ ধরতে না পারায় কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদন হয়নি। এছাড়া দস্যুদের চাঁদাবাজি ও জেলে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই অনেক মহাজনকে ব্যবসা গুটিয়ে চর ছাড়তে হয়েছে। এতে লাখ লাখ টাকার লোকসান গুনে অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে এ বছর বহু মহাজনই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন।
সুন্দরবন বিভাগ জানিয়েছে, দেশের মোট উৎপাদিত শুঁটকির প্রায় ৮০ শতাংশই আহরিত হয় দুবলার চর থেকে। বিশাল এই কর্মযজ্ঞে অংশ নেন কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন এলাকার প্রায় ১০ হাজার মানুষ।
এবার শুঁটকি আহরণ মৌসুমে জেলে-মহাজনদের জন্য ৯০০টি অস্থায়ী থাকার ঘর, ১০০টি ডিপো ঘর এবং নিত্যপণ্যের ৮০টি দোকান ঘর তৈরির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব ঘর ও মাচা তৈরিতে বনজ সম্পদ ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ; সমস্ত মালামাল নিজ নিজ এলাকা থেকে আনতে হবে। দু’এক দিনের মধ্যে দুবলার শুঁটকি পল্লীতে তৈরি হয়ে যাবে অস্থায়ী জেলে গ্রাম। এরপরই ফিশিং ট্রলার ও নৌকা নিয়ে সাগরে গিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আহরণ করে শুঁটকি তৈরি করবেন জেলেরা।
সাতক্ষীরার আশাশুনি এলাকার মৎস্য ব্যবসায়ী ও চাকলা মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি আ. রউফ মেম্বর আলোরকোল থেকে মোবাইল ফোনে জানান, গত বছর তার প্রায় ১২ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। তার সমিতিতে ৩০০ মহাজন এবং প্রায় পাঁচ হাজার জেলে সদস্য রয়েছেন। দুর্যোগ ও দস্যুদের অত্যাচারে বেশিরভাগ মহাজনই লোকসানে ছিলেন। পুঁজি জোগাড় করতে না পারায় এবছর তার এলাকার সাইফুল্লাহ বিশ্বাস, আ. হালিম বিশ্বাস, আ. খালেক সানা, নূর নবী শেখ, মোজাহার আলী সানা, নূর মোহাম্মদ শেখসহ ২০–২৫ জন মহাজন শুঁটকি উৎপাদনে আসতে পারেননি। দেনার চাপে তাদের ব্যবসাই বন্ধ হয়ে গেছে।
বাগেরহাটের রামপাল জেলে সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির শেখ আলোরকোল থেকে জানান, গত মৌসুমে তার নিজেরই প্রায় ১৫ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এবছর পুঁজি জোগাড় করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। তার সমিতির অধীনে ৫০ জন মহাজন ও প্রায় এক হাজার জেলে সদস্য রয়েছেন। গতবারের লোকসান কাটিয়ে উঠতে না পারায় এবছর ১০ থেকে ১২ জন মহাজনের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে।
আতঙ্ক ও হতাশা প্রকাশ করে শুঁটকি পল্লীর ব্যবসায়ীরা বলেন, গতবারের লোকসান কাটিয়ে ওঠার আশায় এবছর ধারদেনা করে একেকজন ব্যবসায়ী ১০–১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু মৌসুমের শুরুতেই দুর্যোগের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে আবারও বড় লোকসানে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। তাছাড়া এবার বন ও জলদস্যুদের উৎপাত আরও বেড়েছে। সামনে কী আছে, তা ভেবে আশা-হতাশার দোলাচলে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
আলোরকোল শুঁটকি পল্লীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তানভীর হাসান ইমরান জানান, আলোরকোল হচ্ছে দুবলার চরের সবচেয়ে বৃহত্তম শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্র। এই একটি চরেই ৭–৮ হাজার মহাজন ও জেলে শ্রমিক রয়েছেন। সকাল থেকে জেলেরা ঘর ও মাচা তৈরির কাজ শুরু করেছেন। দু’এক দিনের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হবে। এরপর থেকেই মৎস্য আহরণ শুরু করবেন তারা।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এ জেড এম হাসানুর রহমান এই প্রতিবেদকে বলেন, এবছর শুঁটকি মৌসুমে পাঁচটি চরে ৯০০ অস্থায়ী ঘর, ১০০টি ডিপো এবং ৮০টি দোকান ঘর তৈরির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব অস্থায়ী ঘর নির্মাণে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিজ নিজ এলাকা থেকে আনতে হবে।
দুবলার চরের শুঁটকি আহরণকারী জেলে ও মহাজনরা কোনো বন্যপ্রাণী শিকার বা বনজ গাছপালা কেটে ব্যবহার করতে পারবেন না। এই বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা অমান্য করে বনের ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডিএফও রেজাউল করিম আরও বলেন, সুন্দরবনের অস্থায়ী জেলে পল্লীগুলো থেকে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ শুঁটকি উৎপাদন হয়। গত মৌসুমে দুবলার শুঁটকি থেকে বন বিভাগের রাজস্ব আয় হয়েছিল প্রায় ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এবছর ৮ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে আশা করছি।
দস্যুদমন ও জেলেদের নিরাপত্তা বিষয়ে তিনি বলেন, শুঁটকি পল্লী সংশ্লিষ্ট বন বিভাগের সব টহল ফাঁড়ির বনরক্ষী ও স্মার্ট টহল দলের পাশাপাশি দুবলা, কচিখালী ও কোকিলমুনি ক্যাম্পের কোস্টগার্ড ও র্যাব সদস্যরা নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকবেন। এছাড়া সুন্দরবনের দস্যুদমন কার্যক্রমে কোস্টগার্ডের নিয়মিত অভিযানও অব্যাহত রয়েছে।