সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : কপোতাক্ষ নদের তীরে ছোট্ট কুঁড়েঘর। ঘরটিই আমিরন বিবির রাজপ্রাসাদ। দুঃখ আর দুর্যোগকে সঙ্গী করেই বসবাস করছেন এখানে। এ ঘরে থেকেই সিডর, ফনি, বুলবুলসহ একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেছেন ৫০ বছর বয়সী আমিরন বিবি।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন উপকূলীয় পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালি বাজার সংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের তীরে এভাবেই একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছেন আমিরন বিবি। ২০ বছর আগে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। তখন থেকেই একা যুদ্ধ করছেন তিনি।
আমিরন বিবি বলেন, ‘২০০৯ সালে আইলার পর থেকে এখানেই বসবাস করছি। একটা মেয়ে, নাম ববিতা। তাকে নিয়েই আমার বসবাস। প্রাকৃতিক দুর্যোগে কয়েকবার ঘরটি ভেঙেছে। আবারও মেরামত করে নিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘নদীতে জাল টেনে বাগদার পোনা ধরে বাজারে বিক্রি করি। রোজগারের সেই টাকা দিয়েই চলে সংসার। সারাদিন নদীতে জাল টেনে যে পোনা পাই, তা ২০০-৩০০ টাকা বিক্রি করতে পারি। কোনো দিন আবার তা-ও হয় না। একশ’ বাগদার পোনা বিক্রি হয় ৪০ টাকা।’
সরকারি সাহায্য পেয়েছেন কি-না? এমন প্রশ্নে কেঁদে ফেলেন আমিরন। তিনি বলেন, ‘নদীর তীরে এতগুলো বছর আছি, আজ পর্যন্ত কেউ এক টাকাও সাহায্য করেনি। ইউনিয়ন পরিষদের ১০ টাকা কেজি চালের কার্ডও পাইনি। সরকার ঘর দেয়, তা-ও জোটেনি। নদীর কূল-কিনারা আছে, আমার নাই।’
পদ্মপুকুর ইউনিয়নে নদের কূলে বসবাস করা ৫০টি পরিবারের মানুষের জীবন-জীবিকার গল্পও আমিরন বিবির মতোই। ইউনিয়নের পাতাখালি এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন দাউদ ঢালীর স্ত্রী মনজিলা খাতুন। চার ছেলেকে নিয়ে একটি এনজিওর দেওয়া ঘরে তাদের বসবাস।
মনজিলা খাতুন বলেন, ‘আমাদের কষ্ট দেখার মানুষ নাই। নদীতে জাল টেনে উপার্জন করি। বাগদার পোনা ধরে ঘের মালিকের কাছে বিক্রি করি। এটাই জীবিকার প্রধান উৎস। স্বামী বৃদ্ধ হয়ে অচল হয়ে পড়েছেন। নদী থেকে বাগদার পোনা ধরে ৩০০-৪০০ টাকা রোজগার হয়। তাতেই চলে সংসার।’
পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলে ৫০ পরিবারে শতাধিক মানুষ বাস করে। তারা নদীতে জাল টেনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। অসহায় নারীদের ভিজিডি, ভিজিএফ কার্ড ও চাল দেওয়া হয়। এছাড়া দুর্যোগের সময়ে সাহায্য দেওয়া হয়। এর বাইরে কোনো সহযোগিতা দেওয় হয়।
যাদের ঘর নেই, তাদের ঘর দেওয়ার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকার না দিলে আমি কিভাবে দেবো? এখনো এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।’
শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের উপকূলে বাস করে ৪০ পরিবার। তাদের চিত্রও একই রকম। এখানকার নারীরা নদীতে জাল টেনে মাছ ধরে, পুরুষরা ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করে। দুর্যোগ উপেক্ষা করে নদীর তীরে ছোট্ট কুঁড়েঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করে।
গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জি এম মাসুদুল আলম বলেন, ‘কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়ার তীরে ৪০ পরিবার বসবাস করে। অসহায় মানুষগুলোর দুর্দশার শেষ নেই। তাদের ঘর দেওয়ার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তালিকা প্রস্তুত করে উপজেলা পরিষদে পাঠানো হয়েছে। তবে এখনো কোনো ঘর বরাদ
দেশে দেশে জলবায়ুগত সমস্যার প্রভাব পড়েছে ভিন্নভাবে। জলবায়ুগত সমস্যা বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার নারীদের বহুমুখী বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীর স্বাস্থের ওপর প্রভাব পড়েছে বেশি। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটের সুন্দরবনসংলগ্ন অঞ্চলের লাখ লাখ নারী নদীতে নেট জাল টেনে জীবন নির্বাহ করেন। লবণাক্ত পানিতে দীর্ঘক্ষণ থাকার ফলে তাদের শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে লবণাক্ত পানিতে নেট জাল টানার ফলে নারীর প্রজনন স্বাস্থের ক্ষতি হচ্ছে ।
মূলত লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, নারীর প্রতি সম্মান ও সমান অধিকারের বার্তা ছড়িয়ে দিতে বিশ্বজুড়ে দিবসটির সূচনা। নারীর জীবন সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ের গল্পগুলো একেক দেশে একেক রকম। মানবসৃষ্ট বৈষম্য ও সমস্যার বিরুদ্ধে নারীর সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ের ইতিহাস সাম্প্রতিক কালের।
তবে প্রকৃতিসৃষ্ট দুর্যোগ নারীর জীবনকে তছনছ করে দিলেও সেটি খুব কম উচ্চারিত হয়। যদিও জলবায়ুসৃষ্ট দুর্যোগ মানুষের কর্মকাণ্ডেরই ফসল। পৃথিবীর দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতে জলবায়ু সমস্যার প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। বর্তমান সময়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন।
দেশে দেশে জলবায়ুগত সমস্যার প্রভাব পড়েছে ভিন্নভাবে। জলবায়ুগত সমস্যা বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার নারীদের বহুমুখী বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীর স্বাস্থের ওপর প্রভাব পড়েছে বেশি। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটের সুন্দরবনসংলগ্ন অঞ্চলের লাখ লাখ নারী নদীতে নেট জাল টেনে জীবন নির্বাহ করেন। লবণাক্ত পানিতে দীর্ঘক্ষণ থাকার ফলে তাদের শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে লবণাক্ত পানিতে নেট জাল টানার ফলে নারীর প্রজনন স্বাস্থের ক্ষতি হচ্ছে।
উপকূল জুড়ে লবণাক্ততার ভয়াবহ প্রভাবের কথা এখন লুকিয়ে রাখার মতো বিষয় নয়। জলবায়ু সমস্যায় ফসল কম হচ্ছে। লবণপানির চিংড়ি চাষ ও জোয়ারে লোনাপানির প্রবেশের ফলে উপকূল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে লবণাক্ততার ভয়াবহ প্রভাব। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নারীদের ঘণ্টার পর ঘন্টা কষ্ট করে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। অল্প বয়সে বুড়িয়ে যাচ্ছে নারীরা। লবণপানি পান করার কারণে নারীর গর্ভপাত, ত্বকের ক্ষতিসহ নানা জটিলতায় ভুগতে হচ্ছে।
উপকূলের সার্বিক ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে। খাদ্য সংগ্রহ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাল্যবিবাহ ও সামগ্রিক জীবনে নারীর কষ্টের কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি)- এর তথ্য মতে, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১ ফুট বৃদ্ধি পাবে। ফলে বাংলাদেশসহ দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর উপকূলের বড় একটা অংশ পানিতে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থাৎ তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে পারে ১০ থেকে ৩০ ইঞ্চি। জলবায়ু সমস্যা নারীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা কর্মসূচি (ইউএনএফপিএ) প্রতিবেদন বলছে, ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলে ১ লাখ ৪০ হাজার নিহতের মধ্যে ৭৭ শতাংশ ছিলো নারী।
আর ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের আইলায় আহত ও নিহত মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ নারীই ছিলো ৭৩ শতাংশ। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)-এর উপকূলের পশুর নদী অববাহিকায় করা গবেষণা বলছে, পশুর নদী অববাহিকায় মানুষদের পানি ও অন্যান্য খাবার থেকে দৈনিক ১৬ গ্রাম অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করতে হচ্ছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রা থেকে বেশি। জলবায়ুগত সমস্যায় উপকূলে কর্মসংস্থানের ব্যাপক অভাব দেখা দেয়ায় পুরুষ মানুষকে দূর দূরান্ত গিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে ঘরের সমস্যা সামলাতে হচ্ছে নারীকেই। উপকূলে পানির জন্য হাহাকার চলছে। জ্বালানি কাঠ ও পানি সংগ্রহ করতে নারীকে অনেক বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে। বনের মধ্য দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। অনেক পরিবার পানি সংগ্রহ করতে না পেরে অর্থ খরচ করে পানি কিনে খাচ্ছেন। লবণাক্ত পানি গ্রহণের ফলে অপরিণত শিশুর জন্ম, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন খিঁচুনি, নারীদের জরায়ুসংক্রান্ত ত্রুটি, পানিবাহিত রোগ ও চর্মরোগের সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। কিশোরীদের বাল্যবিবাহ ও স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার ত্বরান্বিত করছে জলবায়ু পরিবর্তন।
জলবায়ু সমস্যার শিকার হয়ে নারীরা উদ্বাস্তু হয়ে শহরে ভিড় জমাচ্ছে। কিশোরীদের শিক্ষাজীবন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। উপকূলে শিক্ষার সুযোগ ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নারী ও কন্যারা। জলবায়ুগত সমস্যা আগামী দিনগুলোতে আরও বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে উপকূলের নারী ও কিশোরীদের জীবন আরো বেশি মাত্রায় নাজুক অবস্থায় উপনীত হবে। উপকূলের নারীদের রক্ষায় বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলায় নারীদের যত বেশি সম্পৃক্ত করা যাবে অভিযোজনের মাধ্যমে নারীরা তত বেশি নিজেদের রক্ষায় সক্ষম হবে। উপকূলের নারীদের অধিকার ব্যতিরেকে সমগ্র নারীর উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারীরা তাদের জলবায়ু ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য সোচ্চার হচ্ছে। দিনকে দিন তাদের দাবি জোরালো হচ্ছে। যারা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়, তারা কেনো জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হবে? উপকূলের নারীদের ক্ষয়ে যাওয়া জীবন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। উপকূলের নারীদের পানির কষ্ট দূর করতে হবে। নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ন্যায্যতা ও অধিকার নিশ্চিতপূর্বক উপকূলের নারীদের এখন অনেক বেশি দরকার মানবিক সহায়তা। নারীর ক্ষমতায়ন, অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব ব্যতীত দেশে নারীর অধিকার বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রনি খাতুন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘তাদের জীবনমান পরিবর্তনের জন্য কাজ করা হচ্ছে। তাদের আমরা ঘর দিতে পারি না। সরকারি ঘর পাওয়ার প্রথম শর্ত নিজস্ব জমি থাকতে হবে। তবে ভূমিহীন তালিকা প্রস্তুত করে বছরে ৪৮ ভূমিহীন পরিবারকে এক একর করে জমি দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘শুধু ঘর দেওয়া ছাড়া সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা উপকূলীয় তারা পেয়ে থাকেন। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এসব বাসিন্দাদের দেওয়া হয়। কেউ বাদ পড়লে আমাকে জানালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।