
বিশেষ প্রতিনিধি : প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার বিধ্বস্ত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূল। নদীর পানি বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা দেয় এ উপকূল জুড়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সুন্দরবনসংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের চরামুখা এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার খোলপেটুয়া নদীর দুর্গাবাটি গ্রামে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বেশ কয়েকটি গ্রাম। মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয় শত শত পরিবার। লোকজন পড়ে খাবার পানির তীব্র সংকটে। বিগত দিনে আঘাত হানা আইলা, সিডর, আম্ফানে বিধ্বস্ত মানুষ আজও উঠে দাঁড়াতে পারেনি। তার ওপর প্রতি বছর ঝড়-ঝঞ্ঝা তো রয়েছেই। সাম্প্রতিক সময়ে এসব অঞ্চল জুড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ থাকছে অধিকাংশ সময়ই মেঘাচ্ছন্ন। উপকূলবর্তী এলাকায় জোয়ারের প্রভাবে নদীর পানি স্বাভাবিকের তুলনায় ৩ থেকে ৪ ফুট উচ্চতায় বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত পানির চাপে ভেঙে যায় এসব অঞ্চলে থাকা নড়বড়ে বেড়িবাঁধ। যার ফলে আবার নতুন করে ডোবে মৎস্য ঘের, পুকুর, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি। পানিবদ্ধতায় স্থবির হয়ে পড়ে জীবনযাত্রা।
এক সাম্প্রতিক খবরমতে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা জেলার কয়রা উপজেলায় অধিকাংশ বেড়িবাঁধের বেশকিছু অংশ নড়বড়ে ছিল। যার ফলে পানির তীব্র চাপ সহ্য করতে না পেরে সেসব বেড়িবাঁধ ভেসে চলে গেছে। বিস্তৃত অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। শুরু হয়েছে আইলা, আম্ফানের মতো মানবেতর জীবনযাপন। কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের দুটি গ্রামে বর্তমান ২০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। আগের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই আবার এমন বিপর্যয় তাদের সর্বস্বান্ত করেছে। ছোট ছেলেমেয়ে, পরিবারে বৃদ্ধদের নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তরিত করতেও তারা বেশ ভোগান্তিতে পড়ছে। প্রায় একযুগ আগে ঘূর্ণিঝড় আইলায় বিধ্বস্ত উপকূলের এসব অঞ্চলে আজ অবধি খাবার পানির সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি লোকজন। উপরন্তু, অতিবৃষ্টি, নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে জলাবদ্ধতায় দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল এলাকায় লবণাক্ত পানির প্রভাবে এবং সুপেয় পানির উৎস না থাকার কারণে উপকূল অঞ্চলের মানুষ খাবার পানির চরম সংকটের মধ্যে রয়েছে। এর ফলে তারা টাইফয়েড জ্বর, রক্ত আমাশয়, ডায়রিয়া, কলেরা, চর্মরোগসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব রোগ তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এজন্য উপকূলবর্তী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে আরো বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে; তা না হলে মানচিত্র থেকে এসব অঞ্চল অতিদ্রুত বিলীন হয়ে যাবে।
তবে এত দুঃখ-দুর্দশার মধ্যেও তারা আশা করে পথ চেয়ে বসে আছে তাদের ঘিরে সরকারের নেওয়া পরিকল্পনার দিকে। কিছুদিন আগে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় উপকূলীয় এলাকায় পুরোনো বাঁধ সংস্কারের পাশাপাশি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে ১ হাজার ২৩ কোটি টাকার ‘সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং-১৫ (শ্যামনগর) পুনর্বাসন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়েছে। পাশাপাশি উপকূলীয় জেলা খুলনার কয়রা উপজেলায় একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে যার পোল্ডার নং- ১৪/১। এখানে ১ হাজার ৭২ কোটি ৩১ লাখ টাকার একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ দুটি উদ্যোগের ফলে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখছে নদীভাঙনে নিঃস্ব হওয়া উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ।
তবে এ জনপদের মানুষকে বাঁচাতে, জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে ইতিমধ্যে যে প্রকল্প দুটি পাশ হয়েছে তা সুপরিকল্পিতভাবে এবং স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি খাবার পানির সংকট, নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থায় সরকারকে আরো বেশি গুরুত্ব দিয়ে উপকূলবাসীর পাশে দাঁড়াতে হবে।
ঘুরেফিরে সকলের ওই একটাই কথা—নাজুক বেড়িবাঁধ সারানোর ব্যবস্থা হলে আইলার মতো আবারও ভাসতে হতো না। আইলা, ফণী, বুলবুলের পর কত আশ্বাসই না এলো; কই, কেউ তো ফিরেও তাকালো না। সবখানে শুধু জোড়াতালি। এভাবে কী বাঁধ টিকানো যায়?
আম্পানে ভেসে গেল বাড়িঘর, চিংড়ি ঘের, ফসলি জমি—সবকিছু। মানুষগুলো আবার নিঃস্ব হয়ে পড়ল। একজন বললেন, কী দরকার ছিল তেল খরচ করে আমাদের কাছে এসে আশ্বাস বাণী শোনানোর! আরেকজন বললেন, বাঁধ সারানো হলে আমরা ঠিক বেঁচে যেতাম!
পশ্চিম উপকূলে খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনির জনপদে কান পাতলে এখন এসব কথা ভেসে আসে। মানুষজন অনেক সমস্যার কথাই বলেন; তার মাঝে ঘুরেফিরে একই কথা। অন্য যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে; তার নেপথ্য কারণ এই নাজুক বাঁধ। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রবল ধাক্কা থেকে বাঁধ রক্ষা করা গেলে তেমন কোন সমস্যা হতো না। বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম পানি ঢুকেছে। মানুষগুলোর পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। হাজার হাজার মানুষ নেমে গেছে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতে। আম্পানের প্রভাব শেষ হওয়ার পর গত সপ্তাহখানেক ধরে চলছে মেরামতের কাজ। খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরার গাবুরা, বুড়িগোয়লিনী, মুন্সিগঞ্জ রমজান নগর কাশিমাড়িসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণের ছবি আসছে একের পর এক।
‘আমরা আর কতকাল আশ্বাস বাণী শুনে শুনে অপেক্ষা করবো? জীবন তো শেষ হয়ে গেল।’ -কথাগুলো বলছিলেন গাবুরার বাসিন্দা খান আবু হাসান। নিজ এলাকার বর্ণনা তুলে তিনি বলছিলেন, দেশের মানচিত্রে গাবুরা উপকূলীয় অবহেলিত অঞ্চল। চারিদিকে নদী বেষ্টিত ৩৩ বর্গ কিলোমিটারে দ্বীপ। এখানে ৪৫ হাজার মানুষ প্রতিবছর নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, নদী ভাঙন, জলাবদ্ধতার কবলে থাকে। মানুষজন জান ও মালের অনিশ্চয়তার মাঝে বসবাস করে আসছে বছরের পর বছর। উপর মহল এটা জানেন; তবুও কোন কাজ হয় না।
খান আবু হাসানের এই ক্ষোভ ঝরানো কথাগুলো কতটা সত্যি? তার কথার সূত্র ধরে খানিক পেছনে ফিরে গেলেই এর প্রমাণ মিলে। ২০০৯ সালের ২৫ মে। দিনটি ছিল সোমবার। সেদিন প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলা প্রলয়ে গাবুরার ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ৯০ শতাংশ। আইলার পরে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এসেছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন- বাঁধ হবে; সাইক্লোন শেলটার হবে। কিন্তু হয়নি। গত বছর এই এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রলয়। তখন বাঁধ ছিঁড়েনি বটে; কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ একেবারে কম ছিল না। ফণী চলে গেল; এলেন মন্ত্রীদ্বয়। একইভাবে আশ্বাস দিলেন তারাও। এই আশ্বাসের ফলোআপও আছে; অক্টোবরে এলাকা ঘুরে এসেছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্যান্যরা। এতকিছুর পরেও আজ পর্যন্ত সে আশ্বাস গল্পই রয়ে গেছে। আর তারই ফল আম্পানের প্রলয়। এটা আম্পানের ছোট ধাক্কাই বলা যায়; কেননা ঘূর্ণিঝড়টি শক্তি কমিয়েই পশ্চিম উপকূলে আঘাত হেনেছে।
আম্পানের আঘাতের আগে বহুবার এই দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা ঘুরে দেখেছি নাজুক পরিস্থিতি। কোথাও বাঁধ আছে অর্ধেক; কোথাও মোটরবাইক তো দূরের কথা; পায়ে হেঁটে যাওয়াও কঠিন। কোথাও আবার দেখেছি স্থানীয় জনসাধারণ নিজেদের উদ্যোগে জোড়াতালি দিয়ে বাঁধ টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এই ইউনিয়নের ধ্বসে যাওয়া যে স্থানগুলোর নাম বার বার সংবাদ মাধ্যমে উচ্চারিত হচ্ছে, সেগুলো আমার চেনা পথ। পারশেমারী, চাঁদনিমুখা, নাপিতখালী, নেবুবুনিয়াসহ আশপাশের এলাকাগুলো কতটা নাজুক অবস্থায় রয়েছে বছরের পর বছর; তার ছবি আমার ফটোফোল্ডারে ঠাসা। স্বাভাবিক জোয়ারেও এসব স্থান জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয়। কোথাও বাঁশের পাইলিং, তার ভেতরে আবার পুরানো টিনের টুকরো দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা। দৃশ্যমান সব ছবি। বলা যায় নাজুক বাঁধগুলোও টিকে আছে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ টিকানোর উদ্যোগের মধ্যদিয়ে। এলাকার মানুষেরা বছরের পর বছর প্রকৃতির সঙ্গে অনেকটা লড়াই করেই বাঁধ টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু আম্পান তাদের সর্বনাশ করে দিয়ে গেল।
এতো গেল শুধু গাবুরার কথা। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ, রমজান নগর, পদ্মপুকুর কাশিমাড়ী, আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া, শ্রীউলা, প্রতাপনগর, খাজরা, খুলনার কয়রা উপজেলার কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশী, দক্ষিণ বেদকাশী, মহারাজপুর, পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি, সোলাদানা, লস্কর এবং বাগেরহাটের রামপাল ও শরণখোলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাঁধ বিধ্বস্ত হওয়ায় গ্রাম, জনপদ, চিংড়ির ঘের, ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। পশ্চিম উপকূল ছাড়াও দক্ষিণের পটুয়াখালী, ভোলা জেলায়ও বাঁধ বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এরফলে এই সময়ের সকল ফসল নষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে চিংড়ির ঘেরে।
সূত্র বলছে, ষাটের দশকে নির্মিত পশ্চিম উপকূলের বাঁধগুলো ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছিল। আশির দশকে এই এলাকায় চিংড়ি চাষের শুরুতে বাঁধ আরও নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এরসঙ্গে লবণপানির ধাক্কা, জোয়ারের পানির প্রবল চাপ এই বাঁধকে নাজুক করে তোলে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিভিন্ন সময়ে এইসব বাঁধ মেরামতের কাজ হলেও যথাযথভাবে কাজ না হওয়ায় বাঁধের এই বেহাল দশা।
এ প্রসঙ্গে পানি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, উপকূল অঞ্চলের বেড়িবাঁধগুলো অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। এর উচ্চতা অনেক কম। এক সময় ১৫ ফুট উচ্চতার বাঁধ করা হয়েছে। তখন ঘূর্ণিঝড়ের এই প্রভাবের চিন্তা বিবেচনায় ছিল না। আগামীতে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়বে কীনা বলা মুশকিল; তবে জলোচ্ছ্বাসের পানির উচ্চতা বাড়বে; এটা বলা যায়। সে কারণে বাঁধের উচ্চতা অন্তত তিন মিটার বাড়াতে হবে। সমুদ্রের দিকে বাঁধ করতে হবে। এক সময় বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে পানি কমিটি করা হয়েছিল। এখন তা সেভাবে কার্যকর নয়। একে কার্যকর করতে হবে। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, উপকূলের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার বাঁধ আম্পানের মত ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত নয়। প্রতি অর্থ বছরে বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে যে অর্থ বরাদ্দ হয়; তা পর্যাপ্ত নয়। এজন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি বিদেশি সাহায্য নিয়ে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব দাবি করেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাজে যেসব দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ আছে; তা আগের চেয়ে অনেকটাই কমে এসেছে। দুর্নীতি রোধে নানামূখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখন স্বচ্ছতার সঙ্গেই সকল প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলা পরবর্তী সময়ের ঝুঁকি মোকাবেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ড বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ‘কোস্টাল এমব্যাকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট’ গ্রহন করে; যা সংক্ষেপে সিইআইপি নামে পরিচিত। পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায় ২০১৯ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু জমি না পাওয়া, নদীর ভাঙন ইত্যাদি কারণে প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে এ সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। এ প্রকল্পের আওতায় খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরে বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। ৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকার প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ব্যয় হচ্ছে ৬৯৬ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে কোস্টাল এমব্যাকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, সিডর ও আইলা পরবর্তী সময়ে উপকূলীয় এলাকায় যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে; তা কমিয়ে আনাই এ প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য। আমরা কাজ করছি। কোন স্থানের কাজ শেষ হয়েছে, কোন স্থানের কাজ কিছু বাকি রয়েছে। বাগেরহাটের শরণখোলায় প্রকল্পের আওতায় নির্মানাধীন একটি বাঁধ আম্পান আঘাতের আগেই ধ্বসে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নদীর ভাঙনের কারণে আগে থেকেই সেখানকার অবস্থা নাজুক ছিল। প্রকল্প প্রণয়নের সময়ে নদী শাসনের বিষয়টি বিবেচনায় ছিল না। সে কারণে প্রকল্পের কাজ শেষ হতে বিলম্বিত হচ্ছে। সময় এ বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে; আরও এক বছর বাড়াতে হতে পারে।
সরকারের ডেল্টা পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে রয়েছে দেশের দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় এলাকার বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কার্যক্রম। ২৭ হাজার ৭৩৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা উপকূলীয় অঞ্চল দেশের অন্যান্য বিশেষায়িত এলাকা থেকে অনেক বড়। ডেল্টা পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, উপকূলীয় অঞ্চলের বিদ্যমান পোল্ডারের কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঝড়বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস ও লবনাক্ততার অনুপ্রবেশ মোকাবেলা করা হবে; পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বন্যার ঝুঁকি হ্রাস করা হবে ইত্যাদি। কিন্তু এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নে উপকূলীয় বাঁধ শক্ত ও উঁচু করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অথচ বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রকল্প পরিকল্পনা, আবেদন, অনুমোদন এবং বাস্তবায়নেই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে বাঁধ সংস্কার প্রকল্পগুলো ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
বাঁধের মালিকানা জনগণকে দেওয়ার দাবি তুলেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও দুর্যোগ ফোরামের আহবায়ক গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি বলেন, দেশের মালিকানা জনগণকে না দিলেও মানুষের জীবন বাঁচাতে অন্তত বাঁধের মালিকানা জনগণকে দিতে হবে। বাঁধ কীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে; সেটা জনগণই ঠিক করবে। ভোলার চরফ্যাসনে জনঅংশগ্রহণে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে সুফল পাওয়া গেছে। আর এখন জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ ভেঙে যেসব স্থান দিয়ে পানি ঢুকেছে; অবিলম্বে সে পানি সরাতে হবে। তা না হলে বাঁধের ভেতরের কৃষি নষ্ট হয়ে যাবে। মানুষ চরম সংকটের মুখোমুখি হবে। কৃষিকে আমাদের মূল কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে।
উপকূল অঞ্চলে বিদ্যমান বাঁধগুলোর সংস্কার এবং নতুন বাঁধ তৈরিতে কমিউনিটির নেতৃত্বাধীন বাঁধ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টান্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ক্লাইমেট ফিন্যান্স এনালিষ্ট এম. জাকির হোসেন খান।
তিনি বলেন, এ পদ্ধতিতে বাঁধ সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হলে একদিকে যেমন খরচ অনেক কমবে; একইসাথে মানুষের মালিকানা প্রতিষ্ঠা পাবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে তদারকির দায়িত্ব দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড শুধুমাত্র বাঁধের ডিজাইন প্রণয়ন ও স্থানীয় নাগরিকদের কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে। যেকোন দুর্যোগে স্থানীয় কমিউনিটিই পারে শত বছরের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কার্যকর প্রাণ ও প্রকৃতি বান্ধব দুর্যোগ সহিষ্ণু টেকসই উন্নয়ন তথা কার্যকর জলবায়ু অভিযোজন নিশ্চিত করতে।
বাঁধ বিপন্ন এলাকার মানুষেরা বলছেন, এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভর করে বাঁধের ওপর। বাঁধের ক্ষতি হলে তাদের সব ভেসে যায়। ফসল নষ্ট হয়, বাড়িঘর নষ্ট হয়। জরুরি খাবার না দিয়ে বাঁধটা শক্ত করে বানিয়ে দেওয়ার দাবিটাই তাদের কাছে প্রধান। বাঁধের ফাঁদ জনজীবন বিপন্ন করে তুলেছে।