সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সুন্দরবনের সামগ্রিক মাছের উপর তেমনভাবে আগে-পরে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি। ফলে মাছের বর্তমান অবস্থা এবং বিলুপ্ত মাছের ওপর নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এবং মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যেসব মাছ মানুষ খায় এবং যেসব মাছ রফতানি উপযোগী সেই সব মাছকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, সুন্দরবনের নদীগুলো থেকে বিষেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, শিরদাড়াওয়ালা মাছ রয়েছে প্রায় ৩০০ প্রজাতির। ১৯৭৮ সালে সাইডেনস্টিকার ও হাইয়ের মত, এর মধ্য বাণিজ্যিক মাছ রয়েছে প্রায় ১২০ প্রজাতির। অবশ্য গবেষক বার্নাকসেকের ২০০০ সালের মতে বাণিজ্য করা হয় এমন মাছের সংখ্যা ২০ প্রজাতির। কাঁকড়-চিংড়ি ১২ প্রজাতির। এছাড়া ৯ প্রজাতির শামুক রয়েছে। সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সব মাছ মিলিয়ে হচ্ছে সাদা মাছ। বাকিরা হলো বাগদা চিংড়ি, গলদা চিংড়ি এবং কাঁকড়া। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, আশির দশক থেকে অবাধে যথেষ্ট চিংড়ির পোনা ধরা শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত মাছের প্রাচুর্য উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে গেছে। দেখা যাচ্ছে, একটা সময় স্থানীয় জনসাধারণের প্রাণিজ প্রোটিন ৮০ শতাংশ পাওয়া যেত মাছ থেকেই। তখন মাছ খাওয়ার সৌভাগ্য এলাকার খুব কম লোকেরই ভগ্যে জুটত। সুন্দরবনের নদীগুলোকে কালা হাঙর, ইলশা কামট, ঠুঁটি কামট, কাসুয়া কামট পাওয়া যেত। ২০১৪ সালে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এরা সংখ্যায় অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে কালা হাঙর তো দেখাই যায় না। পশ্চিম সুন্দরবনেই এখন এদের যা কিছু অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়।
কুঁচে মাছের পাঁচটি প্রজাতি আছে। এর মধ্যে সাগর কুঁচে ও ধাপি কুঁচের অস্তিত্ব প্রায় বিলু্প্তির পথে। আগেকার দিনে বাঘ মাছের মতো দেখতে এই মাছগুলো স্থানীয় লোকজন প্রায় খেত না। যদিও এই মাছের খাদ্যগুণ অসাধারণ। আগে হাজার হাজার কাঁকড়া ধরে জেলেরা কুঁচে মাছ টুকরো টুকরো করে কাঁকড়া ধরার টোপ হিসাবে ব্যবহার করত। আগে শীতকালে সাগরপারের জংলি খালে পূর্ণ জোয়ারের স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে আর্চার ফিশ বা তিরন্দাজ মাছ দেখা যেত। সুন্দরবনের সাতজেলিয়া, সামসেরনগর, গোসাবা প্রভৃতি অঞ্চলের দেওয়ান মুন্ডা, শুকচাঁদ ওরাঁও, নরসিংহ দাস, পানমোনি সোরেনরা জানান, তিরন্দাজ মাছ দেখতে অনেকটা তিতপুঁটি মাছের মতো। এই মাছগুলো পানির কিছুটা ওপরে গাছের পনি বা পাতায় পিঁপড়ে জাতীয় পতঙ্গ দেখে পিচকারির মতো তীব্র পানি ছিটিয়ে পোকাটিকে পানিতে ফেলে দেয়। এরপর অনায়াসে ক্ষুধা নিবৃত্তি করে। সেই হিসেবে এই মাছকে মাংসাশী মাছ বলা যেতে পারে। এই মাছ প্রায় এক ফুট লম্বা হয়।
তবে সুন্দরবনের সবচেয়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় মাছ হলো পারশে মাছ। ১৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা এই বাঙালির জনপ্রিয় জাতভাই বাটা মাছ। এই মাছ এবং খরশুল অত্যন্ত সুস্বাদু মাছ, যা কম-বেশি এখনও পাওয়া যায়। সুন্দরবন অঞ্চলের মারাত্মক বিষাক্ত মাছ কালা মাগুর। বিষাক্ত বলতে এই পরিচিত কালা মাগুরের গায়ের ওপরের কাঁটায় মারাত্মক বিষ রয়েছে। ২০১৪ সালে সমীক্ষায় প্রকাশ, বড় কালা মাগুর এখনও পাওয়া গেলেও দাগি কালা মাগুর বিলুপ্তির পথে। অন্যদিকে ট্যাংরা জাতের গুনশা ট্যাংরা, নোনা ট্যাংরা পাওয়া গেলেও বিশাল আকৃতির শিলং মাছ প্রায় বিলুপ্ত। কাজলী মাছ সহসা চোখে পড়ে না। অপূর্ব সুন্দর সুস্বাদু ভোলা মাছ কইভোলা জেলেদের মতে কম ধরা পড়ে। আগে সুন্দরবনের খালগুলোতে কুৎসিত দর্শন গলগইন্যা মাছ বড়শিতে ধরা পড়ে। এখন ধরা পড়ে কালে-ভদ্রে।
২০১৪ সালের সমীক্ষায় দেখা গেছে, গুটি দাতিনা কিছু পাওয়া গেলেও দতিনা মাছ একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সুন্দরবনের নদী-খাড়িতে অত্যন্ত সুস্বাদু লাক্ষা মাছ দাপটের সঙ্গে ছোট-মাঝারি সাইজের পারশে মাছ, দাতিনা মাছকে তাড়া করে বেড়ায়। এই লাক্ষা মাছ আকারে প্রায় চার ফুট লম্বা হয়। অপরদিকে ২০১০ সালের অপর একটি সমীক্ষায় জানা গেছে, অত্যন্ত জনপ্রিয় তপসে মাছের এই রকম আকাল দেখা দিয়েছে। জেলেরা অন্তত পাঁচ প্রজাতি ঢেউয়া মাছ ধরে নদীতে। এর মধ্যে লাল চেউয়া পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। সুন্দরবন তথা পৃথিবীর সব ক্রান্তীয় ম্যানগ্রোভ বনের প্রতীক মাছ হল মেনো মাছ। এই মাছ ডাগুক মাছ নামেও পরিচিত। প্রজাতি অনুযায়ী ৯ থেকে ২২ সেন্টিমিটার লম্বা হয়।
সুন্দরবনে বলেশ্বর, কাঁটা নদীতে ইলিশ ধরা পড়ে। দুই প্রজাতির ইলিশের মধ্যে চন্দনা ইলিশ কম পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৫ সালের ভেতর পোড়ামহল, আধারমানিক, জোংরা, শুবদি প্রভৃতি অঞ্চলের মাঝারি আকারের বিলুপ্তগুলোতে বৃষ্টির পানি আটকে থাকায় আবার কোথাও জোয়ারের পানি ঢোকায় পোনা ও মিঠাপানির মাছ খাওয়া যায়। বেশিরভাগ জিওল মাছ, কই, শিং, মাগুর, ট্যাংরা, টাকি মাছ, পুটি, খলসে, চ্যালা, ছোট চিংড়িসহ নানা মাছ পাওয়া যায়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে খালে-বিলে নোনা পানি ঢুকছে। ফলে মিঠাপানির মাছেরা বিপন্ন।
এদিকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিশাল ইছামতী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে জনৈক প্রবীণ ব্যক্তি একটি প্রশ্নের উত্তরে জানান, সুন্দরবনে ১৩ ধরনের পদ্ধতিতে মাছ ধরা হয়। ঠেলা জাল, রটেক জালের ছিদ্রগুলো খুব ছোট হওয়ায় মাছের ডিম, চারা, অন্য ছোট মাছ মারা যাচ্ছে। এছাড়া বিষ প্রয়োগেও সুন্দরবন এলাকায় বিশেষ বিশেষ প্রজাতির মাছের মৃত্যুর প্রধান কারণ চলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে কথা হয় পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাসানুর রহমানের সাথে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান সুন্দরবনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে বিষ দিয়ে মাছ শিকারিরা আমরা সব ভাবে এটিকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদ টিকিয়ে রাখার জন্য অনর্গল চেষ্টা করছি তাছাড়া অতি দ্রুতই বন আইন সংশোধন করে জামিন না যোগ্য আইন তৈরি করা হচ্ছে নতুন আইন তৈরি হলে অপরাধের হার অচিরেই কমে আসবে বলে মনে করেন মিস্টার হাসানুর রহমান।