
বিশেষ প্রতিনিধি : জলবায়ু নেতিবাচক প্রভাবে বলি সবচেয়ে বেশি উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। তাদের জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্যসহ সবকিছুতে এই অভিঘাত সরাসরি ভুক্তভোগী তারা। এমতাবস্থায় চলমান বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে (কপ) বিশ্ব নেতাদের উপকূলীয় মানুষের টিকে থাকার লড়াইকে গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।
শনিবার সকাল ১০টায় “কপ৩০–এ জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবিতে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে গ্লোবাল অ্যাকশন দিবসের সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় মানুষের কণ্ঠকে শক্তিশালী করতে উন্নয়ন সংগঠন লিডার্স এ কর্মসূচি পালন করে। এতে উপকূলের সংকট, মানবিক দুর্দশা ও প্রয়োজনীয় করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়। কপ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বিশ্ব জলবায়ু নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই এ আয়োজন করা হয়।
কর্মসূচিতে সুশীল সমাজ, নারী, যুব সম্প্রদায়, কৃষক, জেলে, সাংবাদিক, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। মানববন্ধন ও আলোচনার মধ্য দিয়ে উপকূলের ভয়াবহ জলবায়ু সংকট তুলে ধরা হয়।
এ সময় উপকূলের বাস্তবতা তুলে ধরে উপজেলা জলবায়ু অধিপরামর্শ ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত আজ উপকূলের মানুষের জীবন–জীবিকা, কৃষি, পানিসংস্থান, স্বাস্থ্য- সবকিছুতে প্রভাব ফেলছে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ছে, নদীভাঙনে মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে, নিরাপদ পানির অভাব চরমে। কপ৩০–এ বিশ্ব নেতাদের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা— উপকূলীয় মানুষের টিকে থাকার লড়াইকে গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
ফোরামের সম্পাদক রণজিৎ কুমার বর্মন বলেন- “লবণাক্ততার কারণে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে, কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মিষ্টি পানির উৎস নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। অনেক পরিবার এখনো পুনর্বাসনের প্রতীক্ষায়। জলবায়ু অভিযোজন কর্মসূচিতে বিনিয়োগ না বাড়ালে উপকূলের মানুষ ভবিষ্যতে আরও বড় সংকটে পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলে উপকূলের অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে আরও শক্তিশালী কণ্ঠে কথা বলতে হবে।”
ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের জলবায়ু-প্রভাবিত নারী হিরন্ময়ী রানী নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, “ঘূর্ণিঝড় আম্পানে আমাদের ঘর ভেসে যায়। এরপর লবণ পানির কারণে জমিতে আর ফসল হয় না। পানযোগ্য পানি পেতে কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হয়। আমাদের কষ্টগুলো যেন বিশ্বমঞ্চে পৌঁছায়- এই আশা নিয়েই আজ এখানে এসেছি।”
যুব প্রতিনিধি মোছা. সীমা পারভীন বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে অনিশ্চয়তায় আছে তরুণ প্রজন্ম। চাকরি, শিক্ষা, নিরাপদ পানি- সবকিছুই ঝুঁকির মধ্যে। জলবায়ু ন্যায়বিচারের জোরালো দাবি তুলতে উপকূলের তরুণরা আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে প্রস্তুত।”
আয়োজক প্রতিষ্ঠান লিডার্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়, উপকূলীয় মানুষের জীবন–জীবিকা, পানিসংস্থান, কৃষি, স্বাস্থ্য এবং দুর্যোগ-সহনশীল অবকাঠামো নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে অভিযোজন এবং জলবায়ু ক্ষতিপূরণ তহবিল দ্রুত কার্যকর করা জরুরি। উপকূলের নারী, শিশু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকায় টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনা প্রয়োজন বলেও জানায় সংস্থাটি।
এ অন্যান্য বক্তারা বলেন, গ্লোবাল অ্যাকশন ডে-২০২৫ এর মতো উদ্যোগ উপকূলবাসীর কণ্ঠকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও জোরালোভাবে তুলে ধরতে সাহায্য করবে। বিশ্ব জলবায়ু নেতারা যদি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তাহলে উপকূলীয় মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এদিকে বাংলাদেশের দক্ষিণের উপকূল অঞ্চল যেন এক অন্তহীন সংগ্রামের নাম। লবণাক্ত জল, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা আর দারিদ্র্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকা এই অঞ্চল শুধুমাত্র প্রকৃতির সঙ্গে নয়, এই অঞ্চলের নারীরা তাদের শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়েও এক অবিরাম যুদ্ধ করে চলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরের পানি যখন ধীরে ধীরে বাসযোগ্য বা আবাদযোগ্য এলাকায় ঢুকে পড়ে, তখন সেই নোনাজল শুধু চাষাবাদই নয়, নারীর প্রজননস্বাস্থ্যকেও নীরবে বিপর্যস্ত করে তোলে।
উপকূলের বহু গ্রামে পরিষ্কার খাবার পানির অভাব আজও নিত্যদিনের সমস্যা। পানীয় ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত জলে লবণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় নারীরা নানা স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছেন—প্রজনন সংক্রমণ, ত্বকের সমস্যা, এমনকি উচ্চ রক্তচাপ পর্যন্ত দেখা দিচ্ছে। মাসিকের সময় নিরাপদ ও গোপনীয় পরিবেশের অভাবে মেয়েরা ও নারীরা অস্বাস্থ্যকর উপকরণ ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে, সেই সাথে যন্ত্রণাদায়ক মানসিক অস্বস্তি তো রয়েছেই।
সমস্যার আরেকটি ভিন্ন দিক হলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা। এখনও অনেক পরিবারে মেয়েদের মাসিক নিয়ে কথা বলা লজ্জার বলে ধরা হয়। ফলাফল—তারা প্রয়োজনীয় সঠিক তথ্য, পণ্য বা চিকিৎসা কোনোটাই পায় না। অর্থনৈতিক কষ্টও তখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সামান্য স্যানিটারি প্যাড কেনার সামর্থ্যও অনেকের নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। বন্যাকবলিত এলাকা সমূহের অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে নারীদের জন্য আলাদা স্যানিটেশন বা গোপনীয় জায়গার ব্যবস্থাও থাকে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আইডব্লিউএফএম (ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট) ও সরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) তিনটি গবেষণা করেছে। প্রকাশিত গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশের উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। গবেষণাগুলোর ফলাফলে বলা হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যে হারে বাড়ছে, তাতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত বা লবণাক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে উপকূলের ৪টি জেলার ৮ থেকে ১৫ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হতে পারে। অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে পারে উপকূলীয় জেলাগুলোর লবণাক্ততাও। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে উপকূলের প্রতিবেশ, মানুষের জীবনযাপন, কৃষি, ভূগর্ভস্থ পানি ও অবকাঠামোর ওপর। আইডব্লিউএফএমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের এ উচ্চতা বৃদ্ধি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। এ কারণে উপকূলের প্রতিবেশব্যবস্থা, ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা ও অবকাঠামোর ক্ষতি হতে পারে। এতে খাদ্যনিরাপত্তার সংকট ভবিষ্যতে বড় হয়ে দেখা দিতে পারে।
সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে—মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার, মোবাইল ক্লিনিক, ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি—কিন্তু তা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত পরিসরে। বাস্তব পরিবর্তন আনতে হলে জলবায়ু অভিযোজন নীতির সঙ্গে প্রজননস্বাস্থ্য সেবাকে সংযুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি, স্থানীয় নারী নেত্রী ও বিভিন্ন ধর্মীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের যুক্ত করে সচেতনতা বাড়ানো গেলে সামাজিক ট্যাবু ভাঙা সম্ভব।
উপকূলের নারীরা কেবল ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী নয়; তারা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগে লড়াইয়েরই অগ্রণী সৈনিক। তাদের জীবন-যাপনের অব্যক্ত কথা, তিক্ত অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বকে স্বীকৃতি না দিলে এই সংকটের সমাধান আশা করা কঠিন। এখনই সময়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় ও লবণাক্ত এলাকার নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি আমাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে গুরুত্ব দেওয়ার।