1. mesharulislammonir1122@gmail.com : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন
  2. info@www.sangjogprotidin.com : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন :
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৩৯ অপরাহ্ন

উপকূলের জেলেপল্লীর শিশুরা এখন স্কুলে যাচ্ছে

  • প্রকাশিত: সোমবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৫
  • ২২ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি : ওদের কানে পৌঁছাতো না স্কুলের ঘণ্টা। যে বয়সে হাতে থাকবে বই, কাঁধে থাকবে স্কুল ব্যাগ; সে বয়সে ওরা নদীর উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাছ  ও কাঁকড়া ধরাসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত ছিল। যে বয়সে হাসি-আনন্দে বেড়ে ওঠার কথা; সে বয়সে ওরা মাথায় বহন করে মাছের ঝুড়ি। হাড়ভাঙা খাটুনির কাজে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে ওরা। সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে হয়। রাতে একটু ঘুম। এ যেন ওদের নিয়তির লিখন।
এমন চিত্র সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার উপকূলীয় জেলেপল্লীর শিশুদের। জেলেপল্লীর অধিকাংশ শিশু হয়ে ওঠে মৎস্যজীবী। মাছ ধরা, বিক্রি করা, ট্রলার বা নৌকা থেকে ঝুড়ি ভরে মাছ নামানো সবই পারে। এ শিক্ষা নিতে হয়েছে পরিবার ও পেটের প্রয়োজনে। এভাবেই শিশু বয়সে শ্রমের জালে আটকে যায় জেলেপাড়ার অধিকাংশ শিশুর জীবন।
দারিদ্র্যের কষাঘাত ওদের শ্রেণিকক্ষে যেতে বারণ করে। আর করোনা এ দরিদ্রতায় যোগ করে নতুন মাত্রা। অনেকেরই স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হতো না। পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে কাজে নামে শিশুরা। শৈশব থেকেই শুরু হয় বিবর্ণ কর্মজীবনের সূচনা। উপকূলীয় প্রান্তিক শিশুদের অন্তহীন দুর্দশার কথা বিবেচনা করে তাদেরকে শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত করার পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্য খাতে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের সুরক্ষার জন্য এগিয়ে আসে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা।
এডুকো প্রকল্পের বাস্তবায়নে এবং এডুকো বাংলাদেশ-এর অর্থায়নে বিপদজনক শ্রম চিংড়ী, কাঁকড়া ও মাছ ধরার কাজেজড়িত শিশুদের শিক্ষার আলো ছড়াতে কাজ করছে সংস্থাটি। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হ্রাস করা বিশেষ করে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্য খাতে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিযুক্ত  শিশুদের সুরক্ষা দেওয়া।
এডুকো প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক নাজমা আক্তার বলেন, শ্যামনগর উপজেলায় মুন্সিগঞ্জ, বুড়িগোয়ালিনি, গাবুরা ও কাশিমাড়ী ইউনিয়নে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই চারটি ইউনিয়নের চারটি লার্নিং সেন্টারে ৩৫০ জন শ্রমজীবী শিশুকে শিক্ষাদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই শিশুরা নিয়মিত লার্নিং সেন্টারে এসে লেখাপড়া করছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৫ জন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সুইং মেশিন ও টেইলরিং ও ২৫ জন ইলেকট্রনিকস ও মোবাইল সার্ভিসিংয়ের বিষয়ে তিন মাসের কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। এছাড়া এই সকল শ্রমজীবী শিশুদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ও সুযোগ বৃদ্ধির জন্য শিশুদেরকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরে উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেপল্লীর শিশুরা এখন স্কুলে যাচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রামে শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, লেখাপড়ায় ব্যস্ত রয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ জন শিশু। আকলিমা খাতুন নামের একজন শিক্ষিকা তাদেরকে পাঠদান করাচ্ছেন। গ্রামের ভাড়া করা ছন-বাঁশ-টিনের স্কুল ঘরগুলোর কাঁচা মেঝেতেই শিশুরা সুশৃঙ্খলভাবে ক্লাস করছে। শিশুকেন্দ্র গুলোর শিক্ষার মান এবং অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সুন্দর আচরণে যে কেউ মুগ্ধ হবে।
শিখন কেন্দ্রের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী নয়ন মণ্ডল, ফয়সাল শেখ, মল্লিকা মণ্ডল ফুলঝুরি, সীমা বারুই, সোনামণি সরদারসহ কয়েকজন জানায়, শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে পড়তে তাদের ভালো লাগে। কারণ আগে তারা স্কুলে যেতে পারতো না। বর্তমানে কাজের পাশাপাশি তারা এখানে পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছে। উপকূলীয় এলাকার এই শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে মুক্ত করে শিখন কেন্দ্রে পড়াতে পেরে স্থানীয়দের মাঝেও উৎসাহ দেখা যায়।
মথুরাপুর শিশু শিক্ষাকেন্দ্রের সভাপতি মিসেস নুরজাহান খাতুন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত ঝরেপড়া শিক্ষাবিমুখ শিশুদের কাছে এখন আদর্শ শিক্ষার বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে শিশুকেন্দ্রটি। এখানে পড়াশুনার মান খুবই ভালো। আগে এখানকার শিশুরা স্কুলে যেতে পারতো না। এখন নিয়মিত স্কুল করার পাশাপাশি তারা অবসর সময়ে মা-বাবার সাথে মাছ ও কাঁকড়া ধরে আয় করে থাকে। তবে নিরাপদ পানি সমস্যা অত্র এলাকায় প্রধান সমস্যা। এছাড়া স্কুল ড্রেস, স্কুল ফিডিংচালু থাকলেও শিশুরা স্কুলে যেতে আরও আগ্রহী হয়ে উঠত।
শ্যামনগর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জানান, মূলত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত স্কুল বহির্ভূত শিশুদের শিক্ষার মূল স্রোতে আনার জন্যই এ ব্যবস্থা। এটি দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া উপকূলীয় এলাকায় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অসীম কুমার মৃধা বলেন, এডুকো প্রকল্পের এই কার্যক্রম উপকূলীয় এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় এলাকায় ঝরে পড়া শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো। ছড়িয়ে দিতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন ইদ্রিস আলী। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের এই প্রভাষক ‘স্কুল অব হিউম্যানিটি’ নামে একটি শিক্ষাদান কেন্দ্র চালু করেছেন, যেখানে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে দারিদ্রের কারণে ঝরে পড়া উপকূলীয় এলাকায় শিশুরা।
ক্লাসের জন্য কোনো নির্দিষ্ট কক্ষ নেই। সুন্দরবনে উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পাতাখালি বাজারের একটি পরিত্যক্ত চান্নিতে (টিন বা পলিশেডের ছাউনি বিশিষ্ট স্থান যার চারিদিকে কোনো বেড়া নেই) চলে পাঠদান। প্রতি শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ক্লাস নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে এলাকায় বেশ সাড়া ফেলেছে মানবতার স্কুল।
পাতাখালি বাজারের চা দোকানি সারাফাত হোসেন। কয়েক বছর আগে গাছ থেকে পড়ে পঙ্গু হয়ে যান। তার ৭ বছর বয়সী ছেলে তাসফিরুল ইসলাম এই স্কুলের নিয়মিত শিক্ষার্থী।
সারাফাত জানান, ‘‘আমরা গরীব মানুষ। ছেলেকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়েছি। পরবর্তী সময়ে গাছ থেকে পড়ে আমি পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর ছেলের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ছেলে চায়ের দোকানে আমাকে সহযোগিতা করে। দু’মাস আগে হিউম্যানিটি স্কুলের যুবকদের আহ্বানে ছেলেকে সেখানে ভর্তি করে দিয়েছি।’’
তাসফিরুল মতো অন্তত ৩০ জন ঝড়ে পরা ছেলে মেয়ে হিউম্যানিটি স্কুলের নিয়মিত শিক্ষার্থী।
পড়ালেখায় ব্যস্ত সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় ঝরে পড়া শিশুরা। / ছবি : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
সামাজিক দায়বোধ ও মানবিকতাবোধের জায়গা থেকে বিদ্যালয়টি পরিচালনা করেন  হিউম্যানিটি স্কুলের পরিচালক ইদ্রিস আলী। তিনি জানান, নানা কারণে উপকূলীয় এলাকার দরিদ্র শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়েই তাদের বেড়ে উঠতে হয়। পারিবারিক দৈন্যদশার কারণে প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ে।
তিনি বলেন, ‘‘বিদ্যালয় থেকে ঝরে যাওয়া এসব শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি আবারও তাদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনাটাই আমাদের উদ্দেশ্য। আর যেসব শিশুদের আর বিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাদেরকে মৌলিক শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা হয়।’’
উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, আমজাদ হোসেন পাতাখালি মাদরাসার ইংরেজি শিক্ষক ইয়াছিন আলী, স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জিএম মাহমুদুন্নবী ও মালয়েশিয়া প্রবাসী আব্দুল্লাহ আল মাসুদ এই স্কুলের পরিচালনা পরিচালনাউপদেষ্টা। নির্দেশনার পাশাপাশি বিদ্যালয়টি পরিচালনার জন্য রয়েছে তাদের আর্থিক সহায়তা।

শিক্ষার্থীদের বয়স উপযোগী শিক্ষামূলক আকর্ষণীয় ভিডিও দেখানো, তা প্রদর্শনের মাধ্যমে ক্লাসে মনোযোগী ও স্কুলের প্রতি আকৃষ্ট করা, খেলাধুলা ও ধাঁধার মাধ্যমে তাদেরকে গণিত বিষয়ের মৌলিক ধারণা সৃষ্টি করা, গান, কৌতুক ও অভিনয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠে মনোযোগী ও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা, ভিডিও কার্টুন দেখানোর পাশাপাশি ছবিযুক্ত ছোটগল্পের বই পড়তে উৎসাহিত করা, ক্লাস শেষে ১০ মিনিটের একটি খেলা বা অন্য কোনো জ্ঞানমূলক প্রতিযোগিতা করে পুরস্কার দেওয়া এবং ক্লাস শেষে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। ঝড়ে পড়া শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে এভাবেই পরিচালনা করা হচ্ছে স্কুলটি।
স্কুলটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রভাষক ইদ্রিস আলী বলেন, ঝরে পড়া অথবা অর্থাভাবে স্কুলের চৌকাঠ না মাড়ানো শিশুদের বিনোদনের মাধ্যমে বিকল্প পদ্ধতিতে এখানে শিক্ষা দেওয়া হয়। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তৈরি করে তাদেরকে আবার মূলধারার স্কুলে ফেরত পাঠানোই আমাদের উদ্দেশ্য। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন ও সুন্দরবন রক্ষার বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করা হয়। এসবের মধ্য দিয়ে সুন্দরবন উপকূলবর্তী অঞ্চলের ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে তাদের জীবনকে পরিবর্তন করা।
স্কুলটির বিষয়ে পদ্মপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন এই প্রতিবেদককে‌বলেন, উপকূলীয় এলাকায় একের পর এক প্রাকৃতিক দূর্যোগের আঘাতে এখানকার মানুষ সর্বস্বান্ত। এলাকার অধিকাংশ মানুষ গরীব ও নিম্ন আয়ের। অভাবের তাড়নায় ছেলে মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে পারে না। জীবিকার তাগিদে একটু বেড়ে ওটার সঙ্গে সঙ্গে যে কোনো কাজে লেগে পড়ে।
তিনি বলেন, হিউম্যানিটি স্কুলটি শুরু করার মধ্য দিয়ে এলাকার বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়া শিশুরা নতুন করে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমানে ৩০ জন ঝড়ে পড়া শিশুকে একত্রিত করে পাঠদান করানো হচ্ছে। ধীরে ধীরে এর সংখ্যা আরও বাড়বে। আরও আগেই এরকম একটি বিদ্যালয়ের প্রয়োজন ছিল।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেদারুল ‌ইসলাম ‌ এই প্রতিবেদককে ‌বলেন, ‘‘স্কুলটির বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। আপনার কাছ থেকেই প্রথম জানলাম। তবে উপকূলীয় এলাকায় ঝরে পড়া শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানোর বিষয়টি প্রশংসনীয়। উপজেলা প্রশাসন স্কুলটির বিষয়ে খোঁজ নেবে। এছাড়া সরকারিভাবে সহযোগিতা করার সুযোগ হয়েছে কিনা বিবেচনা করা হবে।’’

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট