1. mesharulislammonir1122@gmail.com : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন
  2. info@www.sangjogprotidin.com : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন :
শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫, ০১:২৩ অপরাহ্ন

জলবায়ুর প্রভাবে লবণাক্ততা গ্রাস করেছে উপকূল ‌

  • প্রকাশিত: শুক্রবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৫
  • ৪৩ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি :  ‌লবণাক্ততার প্রভাবে দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় জনপদের আবাদি জমি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ কৃষি জমি চাষাবাদের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। কোনো কৃষি জমিতে লবণ পানি প্রবেশ করলে পরববর্তী কয়েক বছর সেখানে কোনো ফসল হয় না। তাই বাধ্য হয়ে কৃষকরা পতিত জমি পরিত্যক্ত ঘোষণা করছেন। অনেকে আবার ওই জমিতে ঘের তৈরি করেন।
জেলায় লবণাক্ততায় শীর্ষে রয়েছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর অঞ্চল। সুন্দরবন বেষ্টিত এই জনপদের অধিকাংশ মানুষ কৃষি ও মৎস্য খাত থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। কৃষি আবাদি জমি চাষের অনুপোযোগী হওয়ায় অনেকেই ইতোমধ্যে কৃষি পেশা পরিবর্তন করেছেন।
অন্যদিকে, কৃষি জমির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূলীয় জনপদের গাছপালাসহ অন্যান্য উদ্ভিদ। লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের গাছের ওপর ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছে। পাশাপাশি এই প্রভাব গবাদি পশু থেকে শুরু করে মানুষের ওপরেও বিস্তার লাভ করেছে।

ভুক্তভোগী এই জনপদের বাসিন্দাদের ভাষ্য মতে, বছরের বেশিরভাগ সময় লবণ পানি সহজে প্রবেশ করতে পারে এই অঞ্চলের কৃষি জমিতে। ফলে জমিতে লবণাক্ততার প্রভাব থেকে যায় কয়েক বছর। বাধ্য হয়ে অনেকে কৃষি জমিকে পরিণত করেছেন মৎস্য ঘেরে। তাছাড়া গরু-ছাগলসহ অন্যান্য গবাদি পশু পালন করাটাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। কারণ এই অঞ্চলে পর্যাপ্ত গাছপালা না থাকায় গবাদি পশু পালনের সুবিধা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দাবি, উপকূলীয় এলাকার পতিত জমিতে লবণ সহিষ্ণু জাতের ধান ও সবজি চাষের আওতায় আনা হয়েছে যা আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাবে। প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রে সেটার প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তথ্যমতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাতক্ষীরার ১ লাখ ৮৮ হাজার ৬২৬ হেক্টর আবাদি জমির মধ্য ৮১ শতাংশের বেশি অর্থাৎ ১ লাখ ৫৩ হাজার ১১০ হেক্টর কৃষি জমি লবণাক্ততার প্রভাবে অকৃষি জমিতে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে পতিত জমি রয়েছে ৪০ হাজার ১০১ হেক্টর।
লবণ পানির প্রভাবে ক্ষতিতে শীর্ষে রয়েছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় সুন্দরবন অঞ্চল। এই জনপদের ৩৭ হাজার ১৪৬ হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ৯৯ শতাংশ অর্থাৎ ৩৬ হাজার ৯১০ হেক্টর জমি লবণাক্ততায় রূপ নিয়েছে।

তাছাড়া সদর উপজেলায় ২৯ হাজার ৩১৯ হেক্টর জমির মধ্যে ৬৩ শতাংশ, কলারোয়ায় ১৭ হাজার ৪২১ হেক্টর জমির প্রায় ৩৮ শতাংশ, তালায় ২৮ হাজার ৭৭০ হেক্টর জমির ৬৪ শতাংশ, দেবহাটায় ১৪ হাজার ৭৬১ হেক্টর জমির ৬১ শতাংশ, কালীগঞ্জে ২৬ হাজার ৭৫৩ হেক্টর জমির ভেজতে ১৬ শতাংশ ও আশাশুনি উপজেলায় ৩৪ হাজার ৪৫৬ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে ৮৭ শতাংশ জমি লবণাক্ততায় রুপ নিয়েছে।
গাবুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা হালিম হোসেন বলেন, প্রতি বছরই এই উপকূলীয় জনপদে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদী থাকায় খুব সহজে লবণ পানি কৃষি জমিতে প্রবেশ করে। লবণ পানি যে বছর জমিতে প্রবেশ করে পরবর্তী তিন থেকে চার বছর ওই জমিতে আর কোনো ফসল হয় না। আমার নিজেরও কয়েকটি আবাদি জমি ছিল, কিন্তু প্রতিবছর প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও লবণাক্ততার কারণে ওই জমিগুলোকে বছর চুক্তিতে অন্যকে দিয়েছি। সেখানে বর্তমানে চিংড়ি ঘের করেছে। আমার মতো শত শত কৃষক এই অঞ্চলে রয়েছে যারা বর্তমানে কৃষি পেশা পরিবর্তন করেছে।
উপকূলীয় পাতাখালী গ্রামের মাসুম বিল্লাহ বলেন, এই অঞ্চলজুড়ে এক সময় অধিকাংশ জমিই কৃষি খাতে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানে জমিগুলো রূপ নিয়েছে মৎস্য ঘের আর পতিত জমিতে। এর মূল কারণ হচ্ছে কৃষি জমিতে লবণাক্ততার প্রভাব। আবার অনেকেই রয়েছেন যারা জমিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। কারণ সেখানে ঘের করার উপযুক্ত না। তাই বাধ্য হয়ে জমিতে চাষাবাদ বন্ধ করে দিয়েছে।
রমজান নগর ইউনিয়নের একাধিক বাসিন্দা বলেন, বাধ কেটে জমিতে লবণ পানি প্রবেশ করানোর কারণে জমির উর্বরতা হারিয়ে গেছে। যার ফলে এখন আর আগের মতো আবাদ করা সম্ভব হয় না। তাই কৃষি জমিকে ঘের ব্যবসায়ীদের কাছে বছর চুক্তিতে মৎস্য ঘের করতে দেওয়া হয়েছে। এতে করে এই অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষি পণ্য সংকট তৈরি করেছে।
রমজান নগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আল মামুন বলেন, এই ইউনিয়নজুড়ে লবণাক্ততার একটি বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। যার ফলে এখানে কিছু অঞ্চলের জমিতে লবণ পানি সহিষ্ণু ধান ও তরমুজ হয়ে থাকে। তাছাড়া অন্য কোনো ফসল এই অঞ্চলজুড়ে তেমন হয় না। অনেকেই আগে কৃষি জমিকে মৎস্য ঘেরে পরিণত করেছেন, তবে বর্তমানে সেটা কমেছে কারণ মৎস্য ঘেরে তুলনামূলক লাভ নেই।
শ্যামনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম আতাউল হক বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে লবণ সহিষ্ণু ধানের বীজ বিতরণ করা হয়। কৃষকরা সেই বীজ রোপন করে লাভবান হচ্ছেন। লবণ সহিষ্ণু এই অঞ্চলের জন্য শাক সবজিসহ ধানের বীজ আলাদাভাবে বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। সাধারণত এই অঞ্চলে লবণাক্ততার প্রভাব বেশি থাকায় এখানে অন্য অঞ্চলের শাকসবজিগুলো হয় না। তাই সরকারের পক্ষ থেকে লবণ সহিষ্ণু বীজ বিতরণসহ অন্যান্য কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ঘের ব্যবসাতেও তেমন লাভ নেই। তাই কৃষকরা নতুন করে তাদের জমিকে ঘেরে পরিণত করছে না।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামার বাড়ির) উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে কৃষি আবাদ যোগ্য জমির মাঠের চারপাশজুড়ে উঁচু করে বাধ দেওয়ার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যাতে করে পার্শ্ববর্তী নদ-নদী থেকে লবণ পানি সহজে কৃষি জমিতে প্রবেশ করতে না পারে। উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলের জন্য ধানের ছয় থেকে সাতটি জাতের বীজের গবেষণা চলমান রয়েছে। তাছাড়া ইতোমধ্যে উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলে ধানগুলো চাষাবাদ করে কৃষকরা বেশ লাভবান হয়েছে। লবণাক্ততার কারণে এখানে অন্য কোনো শাকসবজি সহজে চাষাবাদ করা সম্ভব না। তবে বৃষ্টিকালীন সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির শাকসবজি চাষাবাদ করা যায়। কারণ বৃষ্টির পানিতে লবণাক্ততা ধুয়ে চলে যায়। এ সময় কৃষকরা কিছু অংশে শাকসবজি চাষাবাদ করে থাকেন।
আবহাওয়া ও জলবাযুর বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার মাটি ও পানিতে দিন দিন বাড়ছে লবণাক্ততার পরিমাণ। এর ফলে মানুষের সুপেয় পানির যেমন অভাব দেখা দিচ্ছে, তেমনি কৃষি ও মৎস্য চাষ চরম হুমকির মুখে পড়ছে। লবণাক্ততার ছোবলে কৃষি-অর্থনীতি, জীবন-জীবিকাসহ অনেক ক্ষেত্রে ঘটছে নানামুখী সর্বনাশ। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনকে ‘রেড এলার্ট’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নতুন এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষের কর্মকান্ডের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে অপ্রত্যাশিত এবং অপরিবর্তনীয় উপায়ে। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে ঝুঁকিতে পড়বে কোটি কোটি মানুষ। ২১০০ সালের মধ্যে ভেসে যাবে উপকূল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যা প্রতিরোধে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার যেমন কমাতে হবে, তেমনি প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণও বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের উপকূলবর্তী প্রায় ৫৩ শতাংশ অঞ্চল লবণাক্ততা দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত। বর্তমানে দেশের উপক‚লবর্তী এলাকা ছাড়িয়ে এই লবণাক্ততা আক্রান্ত অঞ্চল ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দক্ষিণ-পূর্বে টেকনাফ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে খুলনা-সাতক্ষীরা পর্যন্ত ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দক্ষিণভাগে উপক‚লীয় তটরেখা ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের কোলে বিস্তীর্ণ চর-উপক‚ল-দ্বীপাঞ্চল। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, ল²ীপুর, চাঁদপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ ১৯টি উপক‚লীয় জেলার নদনদী খাল-বিল-খাঁড়ি, পুকুর-নলক‚পসহ পানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৮.৬ লাখ হেক্টর উপক‚লীয় এলাকার মধ্যে ১০.৫৬ লাখ হেক্টর এলাকা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত কবলিত। এই লবণাক্ততার কারণে শুকনো মৌসুমে বিশেষ করে রবি ও খরিফ-১ মৌসুমে ফসল চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ সময়ে মাটির লবণাতক্ততা ৮.০ ডিএ/মি এর উপরে চলে যায়। এছাড়া এই সময়ে নদীর পানির লবণাক্ততা ২৫.০-৩০.০ ডিএস/মি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
লবণাক্ততা দিন দিন কৃষিজমি গিলে খাচ্ছে। জমি হারাচ্ছে উর্বরাশক্তি। ফল-ফসলের বর্ধন, ঘনত্ব বা নিবিড়তা এবং ফলন কমছে। খাদ্যনিরাপত্তা হচ্ছে বিঘিœত। দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার সমস্যা দীর্ঘদিনের। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কৃষি-খামার এমনকি জনস্বাস্থ্য। বিষিয়ে উঠেছে পরিবেশ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য। একবার জমি লোনাক্রান্ত হলে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কঠিন। প্রায় ৪ কোটি উপক‚লবাসী কোনো না কোনোভাবে লোনার শিকার। উৎপাদনশীলতা কমছে সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় উপক‚লে। বেকার, স্থানান্তর ও পেশা বদল করছে মানুষ। প্রকট হচ্ছে দারিদ্র্য, আর্থ-সামাজিক সঙ্কট।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম এ প্রসঙ্গে ইনকিলাবকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বেড়ে যাচ্ছে। এরফলে অস্বাভাবিক সামুদ্রিক জোয়ারে নদ-নদী-খালের মিঠাপানি লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। মিঠাপানির মাছের বৃহত্তম প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীও লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। কৃষিজমি লোনাকবলিত হচ্ছে। লবণ ও চিংড়ি চাষে রূপান্তরিত হচ্ছে ব্যাপক কৃষিজমি। তাছাড়া পরিবেশ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্যের উপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব। পরস্পর নির্ভরশীল জীবনচক্র ও খাদ্যশৃঙ্খল বিঘিœত হচ্ছে। অনেক প্রজাতির মাছসহ প্রাণিকূল, উদ্ভিদ বিলুপ্তির মুখে। লবণাক্ততার সমস্যা ক্রমাগত বাড়ছে।

জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুতর প্রভাবে পৃথিবী এবং সমুদ্র উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, কক্সবাজার উপক‚লে বছরে ৭ দশমিক ৮ মিলিমিটার হারে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। গত চার দশকে দ্বীপজেলা ভোলার প্রায় তিন হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সমুদ্রের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের উপক‚লভাগে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে অস্বাভাবিক উঁচু জোয়ার এবং ছোট ছোট জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে ঘন ঘন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস সিডর, আইলা, আম্ফান, ইয়াসের আঘাতে অধিকাংশ উপক‚লীয় জেলা-উপজেলায় বেড়িবাঁধ কমবেশি বিধ্বস্ত। ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধ দিয়ে অবাধে জোয়ারের পানি ঢুকে ডুবছে অনেক এলাকা। উপরের দিকে স্থলভাগে ছড়িয়ে পড়ছে সামুদ্রিক নোনা পানি এবং কৃষি-অকৃষি জমি ও লোকালয়ে আটকে যাচ্ছে। গ্রাস করছে মিঠা পানি বা স্বাদু পানির নদ-নদী-খালসহ পানির যাবতীয় উৎস। উপকূলে নদ-নদী-খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে নোনা পানির প্রসার ঘটছে দ্রæত। লবণাক্ত পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার ভূগর্ভস্থ পানিও লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। ফল-ফসলের চাষযোগ্য জমিতে লবণাক্ততার হার বেড়েই চলেছে। আবাদী জমির পরিমাণ কমছে, বাড়ছে পতিত জমি। ফলনও হ্রাস পাচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে সমগ্র কৃষি খাতে।

দেশের আবাদী জমির ৩০ ভাগ উপক‚লীয় এলাকায়। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) এবং লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের জরিপে জানা গেছে, ১৯৭৩ সালে দেশের উপক‚লীয় অঞ্চলে ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর লবণাক্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়। ২০০০ সালে লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ২০ হাজার ৭০০ হেক্টর। ২০০৯ সালের জরিপে লবণাক্ত জমি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টর। গত ৩৬ বছরে লবণাক্ত জমি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬ দশমিক ৭ ভাগ। এরমধ্যে গত ১০ বছরে বেড়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ।
গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী-খালগুলো প্রায় শুকিয়ে তলানিতে ঠেকে যায়। তখন উজানের দিক থেকে পানির স্বাভাবিক চাপ ও প্রবাহ থাকে না। অন্যদিকে নিয়মিত প্রবল সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে ভরে যায় উপক‚লের নদ-নদী, শাখানদী ও খাল-খাঁড়িগুলো। সমুদ্রের নোনাপানি স্থলভাগের দিকে এগিয়ে আসে। অনেক নিম্নাঞ্চলে নোনাপানি আটকে থাকে। এরফলে লবণাক্ততা বেড়ে যায়।
তাছাড়া পদ্মা নদীর উজানে গঙ্গায় ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ও পানির প্রবাহ আটকে রাখার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় ভাটিতে অবস্থিত অনেকগুলো নদ-নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে পড়ে। এরফলে বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলে লবণাক্ততা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণাঞ্চল থেকে লবণাক্ততা বিস্তার লাভ করেছে ক্রমশ উজানভাগে যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বৃহত্তর কুমিল্লা-চাঁদপুরসহ উত্তর দিকে প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার পর্যন্ত। নোনার আগ্রাসন আরও উত্তর দিকে বিস্তারের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
চট্টগ্রাম শহরতলীতে অবস্থিত ‘মৎস্য ব্যাংক’ খ্যাত এশিয়ায় জোয়ার-ভাটানির্ভর মিঠাপানির রুই-কাতলাসহ বড় জাতের (কার্প) মাছের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষিত হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৮ পিপিটি (লবণাক্ততা পরিমাপক)। হালদা বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’র প্রভাবে প্রবল জোয়ারের সাথে হালদা নদীতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অতিমাত্রায় অনুপ্রবেশ ঘটে। এর বিরূপ প্রভাবে মিঠাপানির রুই-কাতলা মা-মাছরা এবার (২৬-২৭ মে) ডিম ছেড়েছে সাড়ে ৬ হাজার কেজি। অথচ আগের বছর ২০২০ সালে একযুগের রেকর্ড ভঙ্গ করে ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম মিলেছে।
লোনার আগ্রাসনে সমগ্র উপক‚লে কৃষিসহ সবক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব দৃশ্যমান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যশস্যের নিবিড়তার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে দক্ষিণাঞ্চল। দেশে ফসলের নিবিড়তা গড়ে ২শ’ ভাগ। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলে তা প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, লবণাক্ততার কবলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে কৃষি-খামার, প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য। তাছাড়া খাবারের জন্য মিঠাপানি এবং কৃষিজমিতে সেচের পানির সঙ্কট হবে আরও তীব্র। অনেক প্রজাতির মিঠাপানির মাছ বিলুপ্তির পথে, আরও প্রজাতি হারিয়ে যাবে। তবে ২০৫০ সালের কথা ওই প্রতিবেদনে বলা হলেও সঙ্কট আরো দ্রত হচ্ছে। মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) তথ্য মতে, দেশের উপক‚লীয় অঞ্চলে কৃষি-খামার ভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতিতে বর্তমানে বড় সমস্যার কারণগুলো হচ্ছে পানির উৎসগুলোতে এবং কৃষিজমিতে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা, লোনায় দীর্ঘ সময়ে পানিবদ্ধতা, সেচের পানিতে লবণাক্ততা। এতে করে অনাবাদী ও পতিত জমি বাড়ছে।
লবণাক্ততা কবলিত উপক‚লে রোগব্যাধির প্রকোপ বৃদ্ধি ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় বাংলাদেশের উপক‚লীয় এলাকায় ২০ শতাংশ প্রসূতি লবণাক্ততার কারণে অকাল গর্ভপাতের শিকার হচ্ছেন। গর্ভাবস্থায় অধিক মাত্রায় লবণাক্ত পানি পান করলে খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপ হয়। এ কারণে গর্ভাবস্থায় সন্তান মারা যাওয়ার হার বেশি। আইসিডিডিআরবি’র এক গবেষণায় বলা হয়েছে, লবণাক্ততার কারণে উপক‚লের মহিলারা অকাল গর্ভপাতের শিকার হচ্ছেন শুধু তাই নয়। একই কারণে তিন শতাংশ শিশু মারা যায়। তাছাড়া ডায়রিয়া, আমাশয়, হৃদরোগ, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি বেশিমাত্রায় লক্ষ্য করা যায় উপকূলীয় অঞ্চলে।

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট