সমুদ্রের পানি এগিয়ে আসছে, বাসস্থান ছেড়ে যাচ্ছে উপকূলের মানুষ
প্রকাশিত:
শুক্রবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৫
২৫
বার পড়া হয়েছে
বিশেষ প্রতিনিধি : বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, যেখানে প্রতিদিন মানুষ ।লড়ে যাচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গে। লবণাক্ততা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন, একের পর এক আঘাতে ক্ষয়ে যাচ্ছে জমি, ফসল, ঘরবাড়ি, আর মানুষের জীবন। সমুদ্রের পানি যত এগিয়ে আসছে, পিছিয়ে যাচ্ছে জীবন, পিছিয়ে যাচ্ছে সভ্যতা। গবেষণা বলছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মিঠা পানির অঞ্চল ভবিষ্যতে ৯০% পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে।
কৃষি, মৎস্য, লবণচাষ, সব ক্ষেত্রেই অনিশ্চয়তা। এদিকে উপকূলের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও দুর্বল। রক্তচাপ, কিডনি, এমনকি গর্ভবতী নারীদের জটিলতা পর্যন্ত বাড়ছে।
লবণাক্ততা, ভূমিক্ষয়, নদীভাঙন, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, পানি সংকট, স্বাস্থ্য সমস্যা, পরিবেশগত হুমকি, জীববৈচিত্র্য ধংস। এতসব প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করা উপকূলীয় মানুষগুলো যাবে কোথায়? বিশ্ব কি শুনবে তাদের আর্তনাদ?
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বাড়ছে। সমুদ্রের পানি যত এগিয়ে আসছে, উপকূলের মানুষ ততো বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এবং বাধ্য হয়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। বে অব বেঙ্গল অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরের সাথে যুক্ত বাংলাদেশের ১৯ টি উপকূলীয় জেলার মানুষ সরাসরি প্রতিকূলতায় ভূগছে। লবণাক্ততা, পানি সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াল থাবায় তারা নিরুপায় হয়ে তাদের বসতভিটা ছাড়ছে এবং থাকা শুরু করছে বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে ঢাকার বস্তি গুলোতে এবং বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যেখানে তাদের থাকার কথা নয়।
উপকূল হয়ে উঠেছে অসহনীয়, কপ সম্মেলনে ক্ষতিপূরণ আদায়ে কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ?
চলুন জেনে নেয়া যাক উপকূলীয় মানুষের প্রধান প্রধান প্রতিকূলতা সম্পর্কে।
উপকূলীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বড় হুমকি এখন লবণাক্ততা। জরিপ বলছে উপকূলজুড়ে প্রায় দুই কোটি মানুষ সরাসরি লবণাক্ততার প্রভাবে ভুগছে।
সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের পানি এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ সীমার চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি লবণাক্ত। এই লবণাক্ত পানি শুধু ফসল নষ্ট করছে না,
বরং মানুষের শরীরেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, বুলবুল, মোখা, প্রতিবারই উপকূলের মানুষ হারিয়েছে তাদের ঘর, ফসল, পরিবার। নদীভাঙনে বছরে হাজারো পরিবার বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, লএসব অঞ্চলে ভাঙন যেন এক অবিরাম দুঃস্বপ্ন। জলোচ্ছ্বাসে এক রাতে হারিয়ে যায় বসতি, বেঁচে থাকা মানুষগুলো চলে যায় বাঁধের ওপর, অথবা রাজধানী ও বড় শহরে, যেখানে তাদের জন্য নেই কোনো স্থায়ী আশ্রয়।
যে মাটি একসময় ধান, পাট, বা সবজি ফলাত আজ সেখানে হয় না কিছুই। মাছের ঘেরগুলোও লবণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। কৃষি, মৎস্য, লবণচাষ, সব ক্ষেত্রেই অনিশ্চয়তা। এদিকে উপকূলের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও দুর্বল। রক্তচাপ, কিডনি, এমনকি গর্ভবতী নারীদের জটিলতা পর্যন্ত বাড়ছে। লবণাক্ত পানির জন্য শরীরে চামড়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, চেহারা কালচে হয়ে যাচ্ছে যা মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে বাধা ও সংকট তৈরি করে
লবণাক্ততা ও দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবনের গাছপালা ও বন্যপ্রাণী। জোয়ার-ভাটার ধারা বদলে যাচ্ছে, নোনা পানির অনুপ্রবেশে বিপন্ন হচ্ছে মিঠা পানির মাছ ও কৃষি জীববৈচিত্র্য। প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনেও লবণ ও তাপমাত্রা পরিবর্তনের প্রভাবে প্রবাল রিফ দ্রুত মারা যাচ্ছে। এভাবে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির ভারসামান।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা, যেখানে বসবাস করে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। এখানকার মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিটি অভিঘাত নিজের জীবনে প্রতিদিন অনুভব করছে। পরিসংখ্যান বলছে প্রতি বছর প্রায় ৭-১০ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত। যদি বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২°C পর্যন্ত বেড়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের ১ কোটিরও বেশি উপকূলবাসী স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত হতে পারে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ গড়ে ৩-৭ মিলিমিটার করে বাড়ছে। এইহার অব্যাহত থাকলে, ২০৫০ সালের মধ্যে উপকূলীয় নিম্নভূমির ১৭% পর্যন্ত ডুবে যেতে পারে, যার ফলে অনেক জায়গা স্থায়ীভাবে বসবাস অযোগ্য হয়ে যা
লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে কৃষিজমিতে ফলন কমছে, অনেক জায়গায় ফসল উৎপাদন বন্ধ। পানযোগ্য জলের তীব্র সংকট। নারীদের গর্ভকালীন সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, চর্মরোগ বাড়ছে। মিঠা পানির মাছ ও গাছপালা বিলুপ্ত হচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভূমিক্ষয় ও নদীভাঙনের ফলে ক্রমবর্ধমান বাস্তুচ্যুতি হচ্ছে (climate migration)। উপকূলের অনেক গ্রাম মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। চরম পানির সংকট ও স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিচ্ছে। পানি বিষের ন্যায় আচরণ করছে, যেটা মনে হতে পারে প্রকৃতির অভিশাপ।
সুন্দরবনের গাছপালা অতিরিক্ত লবণাক্ততায় মারা যাচ্ছে, প্রাণীর আবাস কমছে। সেন্ট মার্টিনের প্রবাল রিফ মারা যাচ্ছে পানির উষ্ণতা বৃদ্ধিত।
কৃষি, মৎস্য ও লবণচাষে অনিশ্চয়তা, মানুষ বাধ্য হয়ে শহরমুখী হচ্ছে, নগর এলাকায় বস্তিবাসী বৃদ্ধি পাচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাহত, শিশু শ্রম বাড়ছে।
বাংলাদেশের উপকূল আজ শুধু প্রকৃতির নয়, মানুষেরও পরীক্ষার মঞ্চ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিটি ঢেউ এখানে আঘাত করে মানুষের জীবনে।
কেউ হারায় ঘর, কেউ ফসল, কেউ আশা।
কিন্তু একটাই সত্য রয়ে যায়, উপকূল এখন শুধু সীমান্ত নয়, মানবতার টিকে থাকার লড়াইয়ের শেষ প্রান্ত।
১৫নভেম্বর স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানে উপকূল এই দিনে । ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূলীয় অঞ্চল বরগুনার পাথরঘাটা।
সিডরের ১৮ বছর হলে ও তাণ্ডবের কথা ভুলেনি উপকূলীয় পাথরঘাটা মানুষ। ১০ মিনিটের তাণ্ডবে নিশ্চিহ্ন করে দেয় উপকূল। ১৮ বছর কেটে গেল ও মানুষের মন থেকে কাটেনি আতঙ্ক। এ ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছে অনেক মানুষ।
১৯ বছরেও স্বাভাবিক হয়নি স্বজন ও সম্পদ হারানো মানুষের জীবন। মাত্র ১০ মিনিটের জলোচ্ছ্বাসে পাথরঘাটার ৩৪৯ জনসহ রগুনা জেলায় ১ হাজার ৩৪৫ জন মানুষ প্রাণ হারালো। ঝড়ের তাণ্ডবে পুরো এলাকা হয়ে যায় লণ্ডভণ্ড। লাশের পর লাশ পড়েছিল উপকূলজুড়ে। কবর দেওয়ার জায়গা পাওয়া যায়নি। সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া পাথরঘাটার ৯১ জন জেলেসহ এখনো নিখোঁজ রয়েছে।
বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন জানেনা তাদের স্ত্রী ও সন্তানরা। তারা এখনো রয়েছে অপেক্ষায় তাদের স্বজনদের। স্বজনরা পাইনি কোন মৃত্যু সনদ সেই কারণে পারছেনা কোন জমি জমা বিক্রি করতে। পাচ্ছে না কোন সরকারি সহায়তা।
বাবা-মায়ের একমাত্র বেঁচে থাকা অবলম্বন ছেলে সেও মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছে নেই তার কোন সন্ধান। সন্তানের শোকে বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় দিন কাটাচ্ছে।সংসারে কোন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকার কারণে মা সালেহাকে মাছ শিকারে যেতে হয় নদীতে। কষ্টে কাটছে দিন পাথরঘাটায় এরকম অনেকেই তাদের পরিবারের প্রধান কে হারিয়ে এখনো কষ্টে কাটছে তাদের দিন।
সিডরে দুই ভাইকে হারিয়ে রহিম বলেন, আমার দুই ভাইসহ সতের জেলে নিয়ে একটি ট্রলার নিখোজ হয়েছে সিডারে। এখনো পাইনি ভাইদের কোন সন্ধান বেঁচে আছে না মরে গেছে।
পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, এই ঝড় কেড়ে নিয়েছে পাথরঘাটার মানুষের সম্বল। কেড়ে নিয়েছে আপনজনদের। তাই এ ক্ষতি অপূরণীয়। সরকারি ও সহায়তাদানকারী সংস্থাগুলো সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করলে উপকূলবাসী স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। একইসঙ্গে পরবর্তী ভয়াবহতার হাত থেকেও রক্ষা পাবে।