বিশেষ প্রতিনিধি : সাতক্ষীরার এল্লারচরে নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের গবেষণা প্রকল্পের ফলাফল প্রদর্শনী ও সমাপনী কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার (২১ নভেম্বর) চিংড়ি চাষ প্রদর্শনী খামার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র মিলনায়তনে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলা এ কর্মশালায় গবেষণা প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি, মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
এ সময় বক্তারা বলেন, বৈশ্বিক বাজারে গুণগত মানসম্পন্ন চিংড়ির চাহিদা এখনো অত্যন্ত বেশি। তাই নিবিড় পদ্ধতির আধুনিক চাষ ব্যবস্থাকে মাঠে বিস্তৃত করতে পারলে সাতক্ষীরা জেলার অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে। পাশাপাশি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার, রোগ নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পরিবেশসম্মত চাষ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে টেকসই চিংড়ি খাত গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
আলোচনায় আশা প্রকাশ করেন চিংড়ি চাষিরা বলেন, সরকার ও উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতা বাড়লে তারা এই নতুন প্রযুক্তি দ্রুত শুরু করতে পারবেন। গবেষণা প্রকল্পের ইতিবাচক ফলাফলকে ভিত্তি করে দেশে নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলেও মত দেন তারা।
সামগ্রিক আলোচনায় বক্তা ও অংশগ্রহণকারীরা একমত হন যে গবেষণা, উদ্ভাবন, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও মাঠপর্যায়ের প্রশিক্ষণ সমন্বিতভাবে এগিয়ে নিতে পারলে বাংলাদেশ খুব অল্প সময়েই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক চিংড়ি উৎপাদক দেশে পরিণত হবে। সাতক্ষীরার অভিজ্ঞতা দেশের অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর জন্য একটি মডেল হিসেবেও কাজ করবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন তারা।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জি এম সেলিম সভাপতিত্বে ও সদর উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলামের পরিচালনায় কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন মৎস্য অধিদপ্তর খুলনা বিভাগের পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম।
এছাড়া আলোচনা অংশ নেন মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগের উপ-পরিচালক বিপুল কুমার বসাক, সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্টের উপপ্রকল্প পরিচালক ড. মো. শরিফুল আজম, সহকারী প্রকল্প পরিচালক আ ন ম মুশফিক সালেহীন ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক ফারহানা তাছলিমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রকল্পের মুখ্য গবেষক ড. মো. হাসান ফারুক ও সহকারী মুখ্য গবেষক ঢাবির অধ্যাপক ড. হাবিবুল্লাহ আল মামুন। নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ সাতক্ষীরায়
সুন্দরবনের পাদদেশে মালঞ্চ নদীরকোলে বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত দেশের সর্ববৃহৎ উপজেলার নাম শ্যামনগর। এ উপজেলার সকল কর্মই যেন সুন্দরবনের সুন্দরের সাথে মিলেই তৈরি হয়েছে। লবণাক্ত পানি আর মিষ্টি পানির মিশ্রণে ফলে সকল প্রকারের ফষল। এ অঞ্চলের লোনা পানির সোনা খ্যাত চিংড়ি চাষ বহির্বিশ্বে পরিচয় ঘটিয়েছে এ উপজেলাকে। সত্তর দশক থেকে সাতক্ষীরাবাসীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে চিংড়ি সম্পদ বিশেষভাবে জড়িত।
বঙ্গোপসাগর থেকে চিংড়ি আহরণের পাশাপাশি সত্তর দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশে প্রথম বৃহত্তর খুলনা জেলায় বাগদা চিংড়ি চাষ শুরু হয়। তন্মধ্যে সর্বপ্রথম চিংড়ি চাষ শুরু হয় তৎকালীন বৃহত্তর খুলনা জেলার অন্তর্গত বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার সদর, দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর থানায়। তখন থেকেই দেশীয় (সনাতন) পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ হয়ে আসছে। বর্তমান সময়ে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে চিংড়ি চাষ সনাতন পদ্ধতিকে পেছনে ফেলে শ্যামনগরে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়িচাষ করে অধিক উৎপাদনে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। আধানিবিড় বা সেমিইন্টেসিভ বলা হয়। যেহেতু ঘেরে চিংড়ি চাষের জন্য বেশি জমির প্রয়োজন হয়, সে কারণে নানা সমস্যা তৈরি হয়। প্রয়োজনীয় উপযোগী জমিরও অভাব রয়েছে। তাই স্বল্প জমিতে পুকুর কেটে এ পদ্ধতির চাষ বেশ সুবিধা ও লাভজনক। অল্প জমিতে অধিক উৎপাদনের ফলে দিন দিন এই চাষ পদ্ধতির ব্যবহার বেড়েই চলেছে। তবে সরকারি বেসরকারি সহায়তা পেলে আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহারে আরো আগ্রহী হবেন চাষিরা। এই পদ্ধতির ফলে চিংড়ির উপযোগী গুণগত মান সম্পন্নের পাশাপাশি এ খাত থেকে বছরে সন্তোষ্ঠ জনক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব বলে করেন সংশ্লিষ্টরা। প্রযুক্তির মাধ্যমে অক্সিজেন, ঔষধ ও খাবার সরবরাহের কারণে সম্পূর্ণ ভাইরাসের ঝুঁকিমুক্ত হওয়ায় পদ্ধতিটি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। সাধারণ চাষের তুলনায় মুনাফার পরিমাণ অধিক হওয়ায় পার্শ¦বর্তী কয়েকটি জেলায়ও এ পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে।
এ বিষয়ে শ্যামনগর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককেবলেন, অল্প জমিতে অধিক মুনাফা লাভের জন্য এই প্রযুক্তির কোন বিকল্প নেই। ইতিমধ্যে আধানিবিড় পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করতে মৎস্য বিভাগও কাজ শুরু করছে। নওয়াবেকী শ্রিম্প কালচারের দেখাদেখি এলাকার অনেক চিংড়ি চাষি এই পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করতে আগ্রহী হয়েছেন। আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। একটি খামারে দুই শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। প্রতিটি পুকুরে বছরে ২ বার মাছ ধরা যাবে। সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক উপায়ে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে অর্থাৎ যদি নিরোগ পোনা ছাড়া হয় তাছাড়া ঘেরে পানির পরিমাণ ৩ থেকে ৪ ফুট, ভালো পানি, ভালো পরিবেশ, জৈব নিরাপত্তা, ভালো মানের খাদ্য, মাছের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এসব সব ঠিক থাকলে ৫ মাসে একর প্রতি ১০ লক্ষ টাকা পাওয়া সম্ভব, যেখানে খরচের পরিমান ৫ লক্ষ টাকা। সনাতন পদ্ধতির অপেক্ষা আধা নিবিড় পদ্ধতিতে ১০গুণ মাছ উৎপাদন করা সম্ভব বলে তিনি জানান।
তিনি আরো বলেন এ পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদন করে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূল এলাকায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে বাগদাচিংড়ি চাষে ব্যাপক সফলতা এসেছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে অক্সিজেন, ওষুধ ও খাবার সরবরাহের কারণে সম্পূর্ণ ভাইরাসের ঝুঁকিমুক্ত হওয়ায় পদ্ধতিটি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। সাধারণ চাষের তুলনায় মুনাফার পরিমাণ বেশি হওয়ায় পাশের কয়েকটি জেলায়ও এ পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে।
শ্যামনগর উপজেলার বাগদা চিংড়ির সেমি-ইনটেনসিভ খামারের ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরের প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, শাওন ফিস প্রডাক্টস লিঃ প্রোঃ প্রয়াত মোঃ আঃ সাত্তার, মোড়ল, ১৩৫.০০ হেক্টর জমিতে যার মধ্যে জলায়তন ৬৪.০০ হেক্টর, পকুরের সংখ্যা ১৮০টি, যার মধ্যে চাষকৃত ১৫৮টি, তার উৎপাদিত মাছের পরিমান ৯৫০.৫০ মেট্রিক টন। রেডিয়েন্ট শ্রিম্প কালচার-০১ প্রোঃ আলহাজ্ব শফিকুল ইসলাম নঁওয়াবেকী, ৪০.০০ হেক্টর জমিতে যার মধ্যে জলায়তন ১৯.৪০ হেক্টর, পকুরের সংখ্যা ৬০ টি, যার মধ্যে চাষকৃত ৪৮ টি, তার উৎপাদিত মাছের পরিমান ২৩০.০০মেট্রিক টন। সুন্দরবনমৎস্য প্রকল্প টাইগারপয়েন্ট, সুশীলন, মুন্সিগঞ্জ, ৩.৫০ হেক্টর জমিতে যার মধ্যে জলায়তন ১.৬২ হেক্টর, পকুরের সংখ্যা ৪ টি, তার উৎপাদিত মাছের পরিমান ২০.০০ মেট্রিক টন। সুন্দরবন শ্রিম্প কালচার লিঃ প্রোঃ আলঃ আবুল কালাম বাবলা, নঁওয়াবেকী, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা ০৫.০০ হেক্টর জমিতে, যার মধ্যে জলায়তন ৩.২৩ হেক্টর, পকুরের সংখ্যা ১০ টি, যার মধ্যে চাষকৃত ৯ টি, তার উৎপাদিত মাছের পরিমাণ ২৩.০০ মেট্রিক টন। মৎস্য বিভাগ অল্প পরিসরে হলেও এ পদ্ধতিতে চাষে এগিয়ে আসার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানায়।
স্থানীয় চাষিদের সাথে এ বিষয়ে কথা বললে তারা জানান, আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করতে আমরা আগ্রহী হলেও মূলত অর্থনৈতিক ঘাটতি থাকার কারণে আমরা এ চাষে অন্তর্ভূক্ত হতে পারছিনা। তবে আমরা জেনেছি এই পদ্ধতিতে চাষে অল্প সময়ে অধিক মুনাফা পাওয়া সম্ভব।
তারা আরো বলেন, এই চাষ পদ্ধতিতে বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। বিদ্যুৎ যেখানে নেই সেখানে ইঞ্জিনচালিত মেশিন অথবা প্রয়োজন মতো সোলারের সাহায্যে চাষ করা সম্ভব। চাষি পর্যায়ে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা এবং বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা গেলে এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষিরা ব্যাপক লাভবান হবে বলে জানান তারা।