সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: বছর দশেক আগে তিন বিঘা জমিতে কুল (বরই) চাষ শুরু করেন মুনছুর আলী খান। ভালো লাভ হওয়ায় লিজ নিয়ে মোট ২০ বিঘা জমিতে এই ফল চাষ করতে থাকেন। মুনছুরের কুলের আবাদ বাড়তে বাড়তে বর্তমানে ১৫০ বিঘায় ঠেকেছে। এত জমিতে কুল চাষ করে সাতক্ষীরার ‘সবচেয়ে বড় চাষি’র খ্যাতি পেয়েছেন তালা উপজেলার কাশিপুর গ্রামের এই বাসিন্দা।
জেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, সাতক্ষীরায় মুনছুর আলীর মতো প্রায় ৩২ হাজার কুলচাষি রয়েছেন। এ জেলায় চলতি বছর মোট ৮৪১ হেক্টর জমিতে কুল চাষ হয়েছে। এর মধ্যে কলারোয়া উপজেলায় চাষ হয়েছে ৪৭০ হেক্টর, তালায় ১৬৫, সদর উপজেলায় ১১২, কালীগঞ্জে ৪৫, শ্যামনগরে ২৫, আশাশুনিতে ২০ ও দেবহাটায় চার হেক্টর। এ বছর (২০২৪-২০২৫) এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার ৪৫৯ টন কুল উৎপাদনের হিসাব পাওয়া গেছে। পাইকারিতে গড়ে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে ৭৪ কোটি ৭৫ লাখ ৪০ হাজার টাকার মতো। এই হিসাব গত বছরের তুলনায় প্রায় আট কোটি টাকা বেশি। মৌসুমি কুলের পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে বারোমাসি কুলের চাষও হচ্ছে।
জেলা কৃষি অফিস জানিয়েছে, ২০২১-২২
অর্থবছরে ৮২৪ হেক্টর জমিতে কুল উৎপাদন হয়েছিল ১১ হাজার ১৮ টন। বিক্রি হয় প্রায় ৬৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮২৯ হেক্টর জমিতে ১০ হাজার ৯৬৫ টন কুল উৎপাদন হয়েছিল; বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৬৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৩০ হেক্টরে উৎপাদন হয়েছিল ১১ হাজার ২১০ টন এবং বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৬৭ কোটি টাকা।
কৃষক মুনছুর আলী জানান, সাতক্ষীরার বেলে-দোআঁশ মাটি ও নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু কুল চাষের জন্য উপযোগী। এ কারণে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। জেলার সাতটি উপজেলাতেই কুল চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। কৃষি কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে কৃষকদের সহায়তা করে থাকেন।
কৃষকরা বলছেন, সাতক্ষীরায় নারিকেল, টক, থাই আপেলসহ বিভিন্ন জাতের কুল পাওয়া যায়। সাধারণত নভেম্বর মাসের দিকে কুল গাছে ফুল আসে। এরপর কুল বাজারে ওঠে ফেব্রুয়ারিতে। প্রথম দিকে দাম একটু বেশি থাকে। পাইকারি হিসেবে প্রতি কেজির দাম ওঠে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। এপ্রিল থেকে দাম কমতে কমতে কেজির দর ৫০ টাকায় দাঁড়ায়।
সবচেয়ে বেশি চাষ কলারোয়ায়, হচ্ছে বারোমাসি কুল
জানা গেছে, ২০১০ সালে কলারোয়ায় সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে কুল চাষ শুরু হয়। সাতক্ষীরার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কুল চাষ হয় এ উপজেলাতেই। ২০১০ সালের পর থেকে সেখান থেকে তালা, এরপর জেলার সব উপজেলায় পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এই ফলের আবাদ ছড়িয়ে পড়ে। জেলার চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন স্থানে সরবারহ হচ্ছে কুল।
কলারোয়া উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, কলারোয়ায় তিন জাতের কুলের চাষ বেশি হচ্ছে– থাই আপেল, বল সুন্দরী ও গোল্ডেন আপেল। এর পাশাপাশি এক জায়গায় স্বল্প পরিসরে বারোমাসি কুলের চাষ হচ্ছে।
জানা গেছে, কলারোয়ায় বছর দুয়েক আগে দেড় বিঘা জমিতে ১০৩টি বারোমাসি কুলের চারা রোপণ করেন হেলাতলা ইউনিয়নের ব্রজবক্স গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মাজেদ। তিনি ২০ বছর ধরে নার্সারির ব্যবসা করছেন। কুলের বিভিন্ন জাতের চারায় কলম করে রসালো ও টকমিষ্টি স্বাদের একটি বিশেষ জাত আবিষ্কার করেছেন মাজেদ। এই জাতের গাছে বারোমাসি কুল ধরে।
আব্দুল মাজেদ বলেন, সাত বছরের চেষ্টায় দুই বছর আগে বারোমাসি কুলের চারা তৈরিতে সফল হই। এরপর নিজের দেড় বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ শুরু করি। প্রথম বছরে ফলন আসা শুরু করে। বর্তমানে একেকটি গাছে ২০ থেকে ৩০ কেজি কুল ধরে। বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে। কুলের পাশাপাশি প্রতিটি চারা বিক্রি করছেন দেড় থেকে ২০০ টাকায়। এ বছর ১২ লাখ টাকার কুল বিক্রির আশা করছি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম এনামুল ইসলাম জানান, এ বছর কলারোয়ায় কুল উৎপাদন হয়েছে ছয় হাজার ৫৮০ টন। খরচ পড়েছে এক কোটি ২২ লাখ টাকা। বিক্রি হয়েছে সাড়ে ছয় কোটি টাকার মতো।
পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কুল চাষে ঝুঁকছেন। তাদেরই একজন কলারোয়ার কয়লা এলাকার মোহর আলী গাজীর মেয়ে কুলচাষি সুন্দরী বেগম বলেন, তিন বছর আগে প্রতিবেশীর বাগান দেখে নিজের চার বিঘা জমিতে কুল চাষ শুরু করি। বিঘাপ্রতি খরচ পড়ছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। কুল বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কেজিতে। প্রথম দিকে লাভ কম থাকলেও এখন বাড়ছে।
সাতক্ষীরা সদরের বাবুলিয়া গ্রামের কুলচাষি নজরুল ইসলাম জানান, তিনি ছয় বছর ধরে ১০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে কুল চাষ করছেন। বিঘাপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার মতো খরচ পড়ে। বিঘাপ্রতি আয় হয় এক থেকে দেড় লাখ টাকা।
কুল ঘিরে গড়ে উঠেছে ১০ বাজার
কুল বেচাকেনা ঘিরে সাতক্ষীরায় অন্তত ১০টি বাজার গড়ে উঠেছে। সেগুলো হলো– জেলা শহরের বড়বাজার, যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের কাজীরহাট ও ব্রজবক্স, সাতক্ষীরা-কলীগঞ্জ সড়কের দেবহাটার পারুলিয়া, নলতা বাজার, আশাশুনির চাপড়া বাজার, খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের ত্রিশমাইল বাজার, শাকদহ, তালা ও আঠোরোমাইল বাজার। এর মধ্যে বড়বাজার ও কাজীরহাটে বেশি কুল বিক্রি হয়।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, তারা ক্ষেত থেকে কুল সংগ্রহ করে খুচরা ও পাইকারি হিসেবে বাজারে বিক্রি করেন। অনেক সময় আড়তদাররা সরাসরি বাগান থেকে কুল কিনে নিয়ে যান।
সাতক্ষীরার বড়বাজারের কাঁচাবাজার আড়ত মালিক মিজানুর রহমান জানান, বছরের শুরুর ফেব্রুয়ারিতে কুলের চাহিদা বেশি থাকে। মার্চ ও এপ্রিলে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দাম কমে। এ সময় ট্রাক ও পিকআপ ভর্তি কুল চলে যায় বিভিন্ন জেলায়।
কৃষি অর্থনীতিতে বাড়ছে কুলের ভূমিকা
কৃষি কর্মকর্তা বলছেন, আমের মতোই সাতক্ষীরার কুলের নাম দেশজুড়ে। এখানকার মাটি ও আবহাওয়া কুল চাষের জন্য অনুকূল হওয়ায় এর চাষাবাদ বাড়ছে। সেই সঙ্গে জেলার কৃষি অর্থনীতিতে বাড়ছে কুলের ভূমিকা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের পরিচালক সাইফুল ইসলাম জানান, তাঁর জানা মতে দেশের মধ্যে সাতক্ষীরাতেই সবচেয়ে বেশি কুল চাষ হয়। তিনি বলেন, এই ফলে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ ও ‘এ’ রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামসহ নানা উপাদান। এগুলো রোগ প্রতিরোধে যেমন ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া কাঁচা ও শুকনো কুল দিয়ে চমৎকার চাটনি ও আচার তৈরি করা যায়। এর থেকেও বাড়তি আয় হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক ইকবাল আহমেদ জানান, কুল চাষের জন্য সাধারণত জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। মৌসুমে পোকা দমনের জন্য কৃষকরা সাধারণত কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন। বর্তমানে জেলার প্রান্তিক কুল চাষিদের জন্য এমএসিপি, এসএসিপি এবং রেইন ক্লাইমেট প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে কৃষকরা সার ও কীটনাশকের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকেন।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রায় সব জেলায় সাতক্ষীরার কুল সরবরাহ করা হচ্ছে। জেলার কৃষি অর্থনীতির ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ভূমিকা রাখছে এই ফল।