সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের বিখ্যাত পামজাতীয় উদ্ভিদ গোলপাতা। সুন্দরবনঘেঁষা এলাকা ছাড়াও বাগেরহাট জেলা সদর, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, রামপাল ও চিতলমারি এলাকার নদী-নালা ও খাল-বিলের পাশে জন্মে গাছটি। মূলত ঘর ছাউনির কাজে ব্যবহৃত হয় এই গাছের পাতা। শখের বসেই গোলফল খাওয়ার চল ছিল উপকূলবর্তী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে।
ছবি: শেহেরীন আমিন সুপ্তি
তালশাঁসের মতো দেখতে এক ফল নিয়ে ভ্যানের ওপর বসেছেন আব্দুর রহমান শেখ। বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদের সামনে তার ভ্যানকে ঘিরে বেশ কয়েকজন উৎসুক পর্যটকের জটলা। কেউ জানতে চাইছেন ফলের আদ্যোপান্ত, কেউ করছেন ভিডিও। আব্দুর রহমানও সোৎসাহে প্রত্যেককে বর্ণনা করছেন বিচিত্র সেই ফলের বিস্তারিত, “সুন্দরবনের গোলপাতা গাছের নাম শুনছেন তো? সেই গোলপাতার ফল এইটা। তালের শাঁসের চেয়েও পুষ্টিকর ফল। শরীরের নানান ব্যথা, ডায়বেটিস, চর্মরোগে ওষুধের কাজ করে গোলফল। খাইলেই শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। বাংলাদেশে আমিই এইটা বিক্রি উদ্বোধন করছি।”
ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের বিখ্যাত পামজাতীয় উদ্ভিদ গোলপাতা। সুন্দরবনঘেঁষা এলাকা ছাড়াও বাগেরহাট জেলা সদর, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, রামপাল ও চিতলমারি এলাকার নদী-নালা ও খাল-বিলের পাশে জন্মে গাছটি। মূলত ঘর ছাউনির কাজে ব্যবহৃত হয় এই গাছের পাতা। শখের বসেই গোলফল খাওয়ার চল ছিল উপকূলবর্তী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে। সুন্দরবনের অঞ্চল ছাড়া দেশের অন্যান্য প্রান্তের মানুষের কাছে অনেকটাই অপরিচিত এই ফল। সম্প্রতি আব্দুর রহমানের উদ্যোগে বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ ঘুরতে আসা বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে পরিচিতি বাড়ছে গোলফলের।
ছবি: শেহেরীন আমিন সুপ্তি
ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন বাগেরহাট সদর উপজেলার সুন্দরঘোনা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রহমান শেখ। প্রায় নয় বছর আগে গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত হয়ে দুই পা হারান তিনি। পঙ্গু অবস্থায় ভ্যান টেনে ছয় ছেলে-মেয়েসহ সংসারের খরচ বহন করতে যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন তখনই এই গোলফল বিক্রির চিন্তা মাথায় আসে তার। বছর চারেক আগে ছোট ছেলেকে নিয়ে আশেপাশের এলাকার নদীর পাড়ে জন্মানো গোল গাছ থেকে ফলের কাঁদি কেটে এনে ষাটগম্বুজ মসজিদের সামনে বিক্রি করতে শুরু করেন তিনি।
গোলগাছে এক কাঁদিতে থাকে ৫০ থেকে ১৫০টির মতো ফল। ছবি: শেহেরীন আমিন সুপ্তি
তালসদৃশ ফলটি নিয়ে পর্যটকদের কাছে অচিরেই বেশ ভালো সাড়া পান আব্দুর রহমান। লম্বায় তিন থেকে চার ইঞ্চি ফলগুলো দেখতে কিছুটা ছোট আকৃতির নারকেলের মতো। গোলফলের এক কাঁদিতে প্রায় ৫০-১৫০টির মতো ফল থাকে। শক্ত খোসা কেটে অপরিপক্ক নরম আঁটিগুলোকে খাওয়া হয় ফল হিসেবে। সাদা রঙের আঁটিগুলো স্বাদে অনেকটা তালশাঁসের মতোই। ঘ্রাণ কিছুটা অন্যরকম।
ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে নদী-নালা ও খাল-বিলের পাশে জন্মে গোলগাছ। ছবি: শেহেরীন আমিন সুপ্তি
গোলফল বিক্রি করে প্রতিদিন প্রায় এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় করেন ৬৫ বছর বয়সী আব্দুর রহমান শেখ। ছুটির দিনে মসজিদে পর্যটকের ভিড় বাড়লে দৈনিক বিক্রি গড়ায় তিন থেকে চার হাজার টাকাতেও। প্রতি আঁটির দাম রাখেন ১০ টাকা। এক প্যাকেট বিক্রি করেন ৫০ টাকায়। বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলা থেকে গোলফল সংগ্রহ করেন তিনি। স্থানীয় কারো বাড়িতে গোল গাছ থাকলে সেখান থেকে প্রতি কাঁদি কিনে আনেন ৩০-৫০ টাকায়। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রোজ বেলা ১২টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ষাটগম্বুজ মসজিদের সামনে বসে গোলফল বিক্রি করেন তিনি।
ঢাকা থেকে সন্তানদের নিয়ে বাগেরহাটে ঘুরতে এসেছিলেন রুবেল ইসলাম। ষাটগম্বুজ মসজিদের সামনে প্রথমবার গোলফল খেয়েছেন তিনি। অপ্রচলিত এই ফল সম্পর্কে তিনি বলেন, “বাচ্চাদের নতুন একটা ফলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলাম, তাই ভালো লাগছে। গোলপাতার নাম শুনলেও আগে কখনো এর ফলের কথা শুনিনি। খেতে তাল কিংবা নারকেল শাঁসের মতো অনেকটাই।”
ময়মনসিংহ থেকে আসা আরেক পর্যটক মৌ নিজের বাড়ির জন্যও কিনে নিয়েছেন গোলফলের কাঁদি। তিনি বলেন, “বাগেরহাটের স্থানীয় নিদর্শনস্বরূপ নিয়ে যাচ্ছি এই ফল। নতুন ধরনের এই ফল দেখে পরিবারের লোকজন বেশ চমকে যাবে।”
বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার মো: আব্দুলাহ আল-মামুন জানান, “কয়েকবছর আগে সুন্দরবন অঞ্চলের গোলগাছের রস থেকে গুড় বানিয়ে এর বাণিজ্যিক প্রচলনের চেষ্টা করেছিলাম আমরা। এই গুড়ে সুগারের পরিমাণ কম থাকায় স্বল্প মাত্রায় ডায়বেটিস থাকা রোগীদের জন্যও নিরাপদ। তবে গোলফলের বাণ্যিজ্যিক প্রচলন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বা বড় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি এখনো।”
উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে গোল গাছের আধিক্য থাকলেও বৃহৎ পরিসরে এর ফলের বাণিজ্যিক বিপণন না হওয়ার কারণ জানতে চেয়েছিলাম বাগেরহাটের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শরণখোলা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা দেবব্রত সরকারের কাছে। তিনি জানালেন, প্রাকৃতিকভাবে মূলত সুন্দরবনের ভেতরে ঝোপ আকারে বেশিরভাগ গোলগাছ দেখা যায়। বনবিভাগের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে প্রতিবছর কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক বাওয়ালি এখান থেকে গোলপাতা সংগ্রহ করতে পারেন। তাও বছরের নির্ধারিত সময়ের বাইরে গোলপাতা আহরণ নিষিদ্ধ। বনের ভেতরে ঢোকার সময়টা সীমিত বলে বেশি পরিমাণে গোলফলও সংগ্রহ করার সুযোগ পাওয়া যায় না।
তার ভাষ্যে, “এই ফলটি এতদিন স্থানীয়রাই খেত। এখন অবশ্য আঞ্চলিক ফলের কদর বাড়ছে দেশজুড়ে শৌখিন মানুষদের কাছে। প্রচুর ভিটামিন ও অ্যান্টি অক্সিডেন্টের উৎস এই গোলফল। এছাড়াও অ্যান্টি অ্যালার্জিক উপাদান থাকায় চর্মরোগের জন্য উপকারি এটি। তাই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষেরা এর প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন। দিন দিন গোলফলের চাহিদা ও বাণ্যিজিক প্রচলনও বাড়বে।”
খুলনার রেঞ্জার
উপকূলীয় উপজেলা কয়রা। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শাকবাড়িয়া আর কয়রা নদী। এই দুটি নদী পার হলেই চোখে ভেসে ওঠে অপার সুন্দরবন। নদীপারের গ্রামগুলোয় হাঁটলে জায়গায় জায়গায় চোখে পড়ে ঝাড় আকারে গজিয়ে ওঠা গোলপাতা। মনে হয় যেন সুন্দরবনের সবুজ ছায়া এসে মিশে গেছে এপারের গ্রামবাংলার চরভূমিতে। গোলপাতার ফাঁক গলে ঝুলে থাকে তালকাঁদির মতো থোকা থোকা ফল, যাকে স্থানীয় লোকজন গোলফল নামে চেনেন।
গ্রামবাসীর কথায়, সুন্দরবন থেকে জোয়ারের ঢেউ বয়ে আনে গোলফল, সেগুলো ভেসে এসে আটকে যায় লোকালয়ের চরভূমিতে। সেখানে অঙ্কুরিত হয়ে জন্ম নেয় নতুন গোলগাছ। সুন্দরবনের অন্যতম খ্যাতিমান পামজাতীয় উদ্ভিদ এটি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Nypa fruticans। বাংলাদেশে পরিচিত ‘গোলপাতাগাছ’ নামে। শাখাহীন এই উদ্ভিদের কাণ্ড থাকে মাটির নিচে, ওপরে ছড়িয়ে পড়ে নারকেলপাতার মতো সবুজ পাতা। গাছের গোড়ায় ধরে কাঁদি কাঁদি গোলফল। ফুলগুলো মোচাকৃতির, দৈর্ঘ্যে প্রায় দেড় মিটার, আর মাথার অংশের ব্যাস প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
সুন্দরবনে গোলগাছে ফুল ও ফল দেখা যায় সারা বছরই। তবে আষাঢ় মাসের দিকেই সবচেয়ে বেশি কাঁদি ধরে। প্রথমে ফুল ফোটে, তারপর ধীরে ধীরে তালের কাঁদির মতো লম্বা হয়ে ওঠে ফলভরা থোকাগুলো। প্রতিটি কাঁদিতে থাকে ৫০ থেকে ১৫০টি পর্যন্ত ফল। অপরিপক্ব অবস্থায় এগুলো কালচে-বাদামি রং ধারণ করে। তিন থেকে চার ইঞ্চি লম্বা প্রতিটি কোয়া দেখতে অনেকটা ছোট আকারের নারকেলের মতো, ওজন হয় ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম। শক্ত খোসা ভেঙে ভেতরের নরম শাঁস, খেতে অনেকটা তালশাঁসের মতো। এতে আছে প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ উপাদান।
লোকজ চিকিৎসায়ও গোলফলের কদর কম না। স্থানীয় লোকজন বলেন, কৃমি দমন, পানিশূন্যতা পূরণ, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি কিংবা চর্মরোগ নিরাময়ে এটি সহায়ক। শিকড় সেদ্ধ করে খেলে আমাশয় ও অনিদ্রার সমস্যার উপশম হয়। কিন্তু গোলফলের কাঁদির আসল বিস্ময় লুকিয়ে আছে এর রসে। অগ্রহায়ণ মাস এলেই গাছিরা কাঁদির ডগা নুইয়ে দেন। এরপর ধারালো দা দিয়ে কেটে দেওয়া হয় ফলভরা থোকা, আর ঝরতে থাকে স্বচ্ছ রস। এই রসের ঘনত্ব খেজুরের রসের চেয়ে অনেক বেশি। যেখানে খেজুরের ষোলো কলসি রস থেকে এক কলসি গুড় হয়, সেখানে গোলের মাত্র আট কলসি রসেই তৈরি হয় সমপরিমাণ গুড়। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর মিষ্টত্ব বেড়ে যায়। এই রস থেকে তৈরি হয় গুড়, পিঠা, পায়েস; আবার অনেকে সরাসরি কাঁচা রস পান করেন।
দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালী, বরগুনা ও খুলনার গ্রামাঞ্চলে গোলের গুড়ের কদর ব্যাপক। কৃষি বিভাগের হিসাবে উপকূলীয় জনপদে বছরে প্রায় ১০ হাজার টন গোলের গুড় উৎপাদিত হয়। শত শত পরিবার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
ঐতিহাসিকভাবে গোলফলের কাঁদি থেকে রস সংগ্রহের সংস্কৃতি এসেছে রাখাইন জনগোষ্ঠীর হাত ধরে। ১৭৮৪ সালে আরাকান থেকে আসা রাখাইনরা কক্সবাজার ও পটুয়াখালীতে বসতি গড়ে তারা সঙ্গে আনে রস সংগ্রহ ও গুড় বানানোর কৌশল। সেই ঐতিহ্য আজও টিকে আছে উপকূলের গ্রামগুলোয়। সম্প্রতি বাগেরহাটের মোংলার মিঠাখালী এলাকায় বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) গোলপাতার রস থেকে গুড় উৎপাদন নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে।
তবে গোলফলের বাণিজ্যিক কেনাবেচা এখনো তেমনভাবে চালু হয়নি। সাধারণত বনজীবী বা উপকূলের মানুষই শখ করে শাঁস খেয়ে থাকেন। তবে ব্যতিক্রমও আছে। বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদের পাশে আবদুর রহমান শেখ চার বছর ধরে পর্যটকদের কাছে গোলফল বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। তাঁর কাছে গোলফল শুধু ফল নয়, বরং জীবিকার আশীর্বাদ।
অন্যদিকে সুন্দরবনের গভীরে যাঁরা অনুমতি নিয়ে গোলপাতা কাটতে যান, তাঁদের বলা হয় বাওয়ালি। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে তাঁদের সংগ্রহ মৌসুম। কিন্তু এই কাজ ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায়ই বেঙ্গল টাইগার লুকিয়ে থাকে গোলপাতার ঝোপে, হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লে প্রাণ হারানোর শঙ্কা থাকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এভাবেই টিকে আছে বাওয়ালি সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকা।
দেশভেদে গাছটির নাম ভিন্ন হলেও বৈশিষ্ট্য এক। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একে বলা হয় গোলপাতা, মিয়ানমারে দানি, শ্রীলঙ্কায় জিং পল, মালয়েশিয়ায় বুয়াহ নিপাহ, ইন্দোনেশিয়ায় বুয়াহ আতপ, সিঙ্গাপুরে আত্তপ, ফিলিপাইনে নিপা আর ভিয়েতনামে দুয়া নুয়ক।
গোলপাতা শুধু একটি উদ্ভিদ নয়; এটি উপকূলীয় মানুষের জীবন, ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঘরের জন্য দেয় ছাউনি, খাবারের জন্য দেয় রস, ওষুধের জন্য দেয় ফল ও শিকড়। প্রয়োজন শুধু সঠিক পরিকল্পনা ও গবেষণা। তাতে একদিন গোলপাতার গোলফল হয়তো হয়ে উঠবে বাংলাদেশের উপকূলের বড় অর্থনৈতিক সম্পদ।