1. mesharulislammonir1122@gmail.com : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন
  2. info@www.sangjogprotidin.com : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন :
মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১০:০৯ অপরাহ্ন

কার্তিক মাসের অন্ধকার রাতের সৌন্দর্য আলাদা

  • প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫
  • ১৮ বার পড়া হয়েছে

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি :  কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাত। পৃথিবীর সমস্ত আলো যেন নিভে গিয়ে অন্ধকারে ঢেকে যায়। অথচ এই অন্ধকারেই শুরু হয় আলো খোঁজার উৎসবÑ শ্যামা কালী পূজা ও দীপাবলী। অন্ধকারে আলো জ্বালানোর এই মানবিক প্রচেষ্টা শুধু ধর্মীয় আচরণ নয়, এটি এক গভীর দার্শনিক অনুধাবনÑ অশুভের মধ্যেও শুভের সম্ভাবনা আছে, অন্ধকারের মধ্যেই জেগে থাকে আলোর জন্মবীজ। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস এক অর্থে অন্ধকার থেকে আলোর অভিযাত্রা। যখন আদিম মানুষ অন্ধকারকে ভয় পেত, তখন আগুনের আবিষ্কার তাকে শুধু উষ্ণতা নয়, সাহসও দিয়েছিল। সেই আগুনই আজও জীবনের প্রতীকÑ প্রদীপের আলো, জ্ঞানের আলো, মুক্তির আলো।
অমাবস্যার রাত তাই কেবল জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা নয়, এটি এক মানসিক রূপক। যখন চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে যায়, তখনই মানুষ প্রদীপ জ্বালেÑ নিজের ভেতরের আলো জাগিয়ে তোলার প্রয়াসে। কালী পূজার প্রদীপ তাই প্রতিটি আত্মার ভেতরের অন্ধকার দূর করার প্রতীক। কালী বা শ্যামাÑ তাঁকে অনেকে ভয়ঙ্কর বলে দেখেন, কিন্তু প্রকৃত অর্থে তিনি ‘ভয়’-এর মুক্তিদাত্রী। তাঁর গায়ের রং অন্ধকারের মতো, মুখে রক্তের হাসি, হাতে অস্ত্রÑ কিন্তু এই ভয়াবহ রূপ আসলে ভয়ের প্রতিষেধক। যে ভয়কে তিনি ধারণ করেন, সেই ভয়ই আমাদের থেকে মুছে দেন।
তাঁর গাঢ় কালো রূপ সময়ের প্রতীকÑ ‘কাল’ অর্থ সময়, ‘কালী’ অর্থ সেই সময়ের অধিষ্ঠাত্রী। সময় যেমন সৃষ্টি করে, তেমনি ধ্বংসও আনে। তাই তিনি একাধারে মা ও মহাকাল। কালী হলেন সৃষ্টির আদিকারণÑ যিনি শূন্য থেকে বিশ্বব্রহ্মা- সৃষ্টি করেন, আবার সেই বিশ্বকে নিজের কোলে টেনে নেন। পুরাণকথায় দেবতারা যখন অসুরদের দমন করতে ব্যর্থ, তখন দেবী দুর্গার কপাল থেকে কালী জন্ম নেন।
তিনি উন্মত্ত রণরূপে যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন, অসুরদের ধ্বংস করেন, এমনকি নিজের রক্তপিপাসা মেটাতে নিজের রক্ত পান করেন। কিন্তু শিবের দেহের উপর পা পড়তেই দেবী থেমে যানÑ তাঁর চোখে জেগে ওঠে লজ্জা, মুখে জিভের কামড়। এই এক মুহূর্তেই ভয় থেকে মমতার জন্ম হয়। দেবীর মধ্যে ‘রুদ্র’ ও ‘করুণা’Ñ দুই বিপরীত শক্তির মিলন ঘটে। তাই কালী কেবল সংহারক নন, তিনিই সৃষ্টির রক্ষাকারিণী, মাতৃত্বের প্রতীক। তন্ত্রশাস্ত্রে কালীকে বলা হয় ‘আদ্যাশক্তি’। তিনি হলেন সেই মূল শক্তি, যাঁর স্পন্দনেই সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় ঘটে।
এই ধারণা কেবল ধর্মীয় নয়, এটি গভীর দার্শনিকÑ পৃথিবীর প্রতিটি কর্ম, পরিবর্তন, এমনকি বিবর্তনের পেছনে কোনো না কোনো শক্তি কাজ করছে। সেই শক্তি নারীর মধ্যেই নিহিত। এ কারণেই কালী পূজা নারীর প্রতি এক বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তোলে। নারী শুধু কোমলতা নয়, শক্তিও বটে। মা কালী সেই শক্তিরই প্রতীকÑ যিনি সন্তানকে যেমন বাঁচান, তেমনি মন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেন। একই রাতে পালিত হয় দীপাবলীÑ আলো জ্বালানোর উৎসব।
রামায়ণ মতে, রাবণ বধ শেষে শ্রী রাম অযোধ্যায় ফিরে আসেন এই দিনেই, আর প্রজারা আনন্দে ঘরবাড়ি আলোকিত করে। কিন্তু এই আলো কেবল উৎসবের আলো নয়Ñ এটি অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানের মুক্তি, অন্ধকার থেকে সত্যের উন্মেষ। প্রদীপ জ্বালানো মানে নিজের অন্তরের আলো জ্বালানো। আমাদের সমাজেও যখন বিভাজন, হিংসা, হানাহানি বাড়ছে, তখন প্রতিটি প্রদীপ যেন মনে করিয়ে দেয়Ñ সত্যিকারের দীপাবলী বাইরে নয়, ভেতরে ঘটতে হয়। আজকের সমাজে ‘অশুভ’ শব্দের রূপ বদলেছে।
এখন আর দানবরা শৃঙ্গধারী নয়, তারা অর্থলোভ, সহিংসতা, স্বার্থপরতা ও হিংস্রতার রূপে উপস্থিত। কালী পূজার বার্তা তাই আজও প্রাসঙ্গিকÑ মন্দকে দমন করে শুভকে জাগানো, ভয়ের মধ্যে শক্তি খোঁজা। দেবী কালী আমাদের শেখানÑ ভয়কে দমন করার একমাত্র উপায়, তাকে মুখোমুখি দেখা। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে মানুষ নিজের ভেতরের অন্ধকার চিনতে পারে। তাই কালী হলেন আত্মচেতনার প্রতীকও।
বাংলাদেশে কালী মাতার পূজা বিশেষভাবে জনপ্রিয়। সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন এলাকায়Ñ পুরাতন সাতক্ষীরা,তালার জালার পুর, বুধহাটা, কাটিয়া, কলারোয়া, আশাশুনি, তালা ও শ্যামনগরেÑ প্রতি বছর শ্যামা পূজা মহা ধুমধামে পালিত হয়। এই পূজার সামাজিক দিকও অনন্য। গ্রামের মানুষ একত্র হয়, সমাজের ভেদাভেদ মিলিয়ে যায়, সবার মুখে একটাই মন্ত্রÑ “জয় মা কালী।”
এ যেন ধর্মীয় উৎসবের ভেতর দিয়ে সামাজিক ঐক্যের নবজাগরণ। দীপাবলীর রাতে যখন অসংখ্য প্রদীপ জ্বলে ওঠে, তখন মনে হয়Ñ প্রতিটি প্রদীপ যেন একেকটি আত্মা, যা নিজের অন্ধকার ভেদ করে আলোর পথে পা রাখছে। এই আলোর উৎসব আমাদের শেখায়Ñ অন্ধকার অনিবার্য, কিন্তু আলোও অনন্ত। মানুষের জীবনে যেমন দুঃখ, ভয়, ক্ষয় অনিবার্য, তেমনি তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে আনন্দ, আশা ও সৃষ্টি। কালী সেই চিরন্তন বার্তাই দেনÑ ধ্বংসই শেষ নয়, প্রতিটি ধ্বংসের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা। এই পূজা আমাদের শেখায়Ñ ভয়কে দূরে সরিয়ে শক্তিকে গ্রহণ করা। সমাজে যখন অন্যায়, দুর্নীতি, ধর্মীয় বিদ্বেষ বাড়ছে, তখন কালী পূজার প্রকৃত তাৎপর্য হলোÑ ন্যায়, জ্ঞান ও মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো। দেবী কালী যেমন শ্মশানের দেবী, তেমনি জীবনের দেবীও।
শ্মশান মানে শেষ নয়, বরং রূপান্তর। প্রতিটি অন্ধকারই নতুন আলো জন্ম দেয়, প্রতিটি ক্ষয়ই নতুন সৃষ্টির পথ তৈরি করে। আজকের এই প্রযুক্তিনির্ভর, বিভ্রান্ত সময়েও মানুষ যখন আশ্রয় খোঁজে, তখন সে ফিরে যায় মায়ের কোলেÑ সেই মা শ্যামা, যিনি ভক্তদের সকল ভয় থেকে মুক্তি দেন, অন্ধকারে আলোর দিশা দেখান। তাই শ্যামা কেবল পূজার দেবী নন, তিনি এক চেতনাÑ যে চেতনা বলে, “ভয় নয়, প্রেমই শক্তি। অন্ধকার নয়, আলোই সত্য।” কার্তিকের এই অমাবস্যায় তাই কালী পূজা শুধু ধর্মীয় আচার নয়,এ এক আত্মার জাগরণ, মানবতার দীপাবলী।

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট