
সাতক্ষীরাপ্রতিনিধি: দেবহাটায় গলদা চিংড়ি মাছ চাষে ভাগ্য বদলে গেছে চাষীদের উপজেলায় প্রায় ১৮০ জন গলদাচিংড়ি চাষ করেছেন সবাই এই চাষের লাভের মুখ দেখেছেন তার মধ্যেও আমিরুল ইসলামের ভাগ্য বদলে গেছে। কয়েক বছর আগেও তাঁর জীবনে ছিল শুধু হতাশা। ঘেরে চিংড়ি মজুদ করতেন, কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই রোগে মারা যেত। একসময় তিনি ভেবেছিলেন, ভাইরাসই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। প্রতিবার চাষে লোকসান গুনে পরিবার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছিল। স্ত্রী-সন্তানের মুখে হাসি নয়, বরং অনিশ্চয়তার কালো ছায়াই ছিল নিত্যসঙ্গী।
ঠিক তখনই আশার আলো হয়ে আসে মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট। অফিসের বিশেষজ্ঞরা তাঁর ঘের পরিদর্শন করে জানান, সমস্যা ভাইরাস নয়, বরং ঘেরের অগভীর পানি ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব। শুরু হয় নতুন সংগ্রাম, নতুন যাত্রা, পরিবর্তনের যাত্রা।
পরে তিনি মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্টের আওতায় ঘের উন্নয়ন ও আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ের উপরে প্রশিক্ষণ নেয়, প্রশিক্ষণে যার মধ্যে চিংড়ি চাষের মৌলিক প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ, ঘের ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ, ব্যবসায়িক পরিকল্পনা প্রস্তুতকরন প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক বাজার বিষয়ে জ্ঞান, হাতে-কলমে চাষ ব্যবস্থাপনা ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার বিষয়ক উচ্চতর প্রশিক্ষণ, মৎস্য দপ্তরের অনুদান ও সহায়তা চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার জন্য মৎস্য দপ্তর তাঁকে মোট ২,১৪,৬৭৮ টাকা অনুদান প্রদান করে।
আগে যেখানে ঘেরে পানি পরীক্ষা, মানসম্মত খাদ্য ব্যবহার, জৈবনিরাপত্তা এসব কিছুই উপেক্ষিত ছিল, সেখানে এখন তিনি প্রতিটি ধাপ নিয়ম মেনে করছেন। তিনি নিজে মাটি ও পানির সকল পরীক্ষা করতে পারেন। মৎস্য দপ্তরে পিসিআর মেশিন থাকায় প্রয়োজনে পিএল রোগমুক্ত কিনা তা পরীক্ষা করতে পারেন। চাষের শুরু থেকে শেষ সকল তথ্য রেকর্ড বুকে লিখে রাখেন। নিরাপদ মাছ উৎপাদনের জন্য ঘেরে ব্যবহার করেন না কোন ধরনের এন্টিবায়োটিক।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চিংড়ি চাষে নানা ঝুঁকি যেমন পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি, লবণাক্ততার পরিবর্তন ও হঠাৎ বৃষ্টিপাতের কারণে উৎপাদন হ্রাস পেত। কিন্তু ক্লাস্টার পদ্ধতিতে একসাথে কাজ করার ফলে চাষিদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সহজ হয়েছে। বিশেষ করে ঘেরে পানির গভীরতা বৃদ্ধি করার কারণে তাপমাত্রার তারতম্য সহজে প্রভাব ফেলতে পারে না, পানির মান স্থিতিশীল থাকে এবং রোগের ঝুঁকিও অনেক কমে গেছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় ক্লাস্টার পদ্ধতি ও গভীর ঘের দুটোই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে আয় বৃদ্ধির ফলে আমিরুল এখন তার ছেলে-মেয়েদের ভালো জামা-কাপড় কিনে দিতে পারেন, প্রয়োজনীয় শিক্ষার খরচ চালাতে পারেন, পরিবারের জন্য উন্নত চিকিৎসা সেবা নিতে পারেন। এমনকি তিনি জমিও ক্রয় করেছেন। আগে যেখানে সংসারে অনিশ্চয়তা ছিল, এখন সেখানে এসেছে নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য।
বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ও সঠিক ইনপুট ব্যবহারের ফলে এবার তার ঘের হয়ে ওঠে লাভজনক। যেখানে আগে উৎপাদন ছিল মাত্র ১.৮ কেজি/শতাংশ, সেখানে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.২ কেজি/শতাংশ।
এক মৌসুমে তিনি উৎপাদন করেছেন ৬২৫ কেজি চিংড়ি, যা বিক্রি করে আয় হয়েছে ৯,০৬,২৫০ টাকা। অর্থাৎ আগে তিনি প্রতি বছর লোকসান করতেন, এখন তিনি শুধু লাভবানই নন, আশেপাশের শত শত চাষির জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। তিনি আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি ও আমার জীবনমান উন্নয়নের জন্য মৎস্য অফিস যা করেছে, তা নিজের বাবা-মা কিংবা আত্মীয়-স্বজনও করে না।
যে আমিরুল একসময় ক্ষতির ভয়ে দিশেহারা ছিলেন, আজ তিনি আশেপাশের চাষিদের কাছে রোল মডেল। তার সাফল্যের গল্প শুনে আরও অনেক চাষি ঘের উন্নয়ন ও বিজ্ঞানভিত্তিক চাষে এগিয়ে আসছেন। মৎস্য অফিসের সময়োপযোগী অনুদান, আধুনিক প্রযুক্তি এবং আমিরুল ইসলামের দৃঢ় মনোবল মিলেই তাঁর এ সফলতা।
আগে যেখানে আমিরুল ইসলাম প্রতিবছর লোকসানের শিকার হতেন, এবার মৎস্য অধিদপ্তরের অনুদান, বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও আধুনিক প্রযুক্তির কারণে তিনি এক মৌসুমেই প্রায় ৯লাখ টাকা নিট লাভ অর্জন করেছেন। এখন তাঁর এই সাফল্য শুধু তাঁর পরিবারের জীবনমান উন্নত করছে না, বরং আশেপাশের শতশত চাষির কাছে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।