
তালা প্রতিনিধি : সমাজ ও পরিবারের নানা বাঁধা কাটিয়ে জীবন সংগ্রামে সাফল্য অর্জন করেছেন সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ৫ নারী। নানা বাঁধা বিপত্তিকে পায়ে মাড়িয়ে তৃণমূল থেকে উঠে আসা এসব নারীদের খুঁজে বের করে অদম্য নারী পুরষ্কার-২০২৫ সালের জন্য ৫টি ক্যাটাগরীতে নির্বাচিত করেছে উপজেলা প্রশাসন। এই ৫ নারীর প্রত্যেকের জীবনে রয়েছে অসীম আত্মশক্তি ও সংগ্রামের আলাদা আলাদা জীবন কাহিনী। তাদের সেই সংগ্রামী জীবনের কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো:
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী রাবিয়া বিবি: জীবন সংগ্রামে দারিদ্রতাকে পিছনে ফেলে সাফল্য অর্জন করেছেন রাবিয়া বিবি। তিনি তালা উপজেলার সরুলিয়া ইউনিয়নের পারকুমিরা গ্রামের নাসের উদ্দীন বিশ্বাসের কন্যা। এক সময়ে কিছুই ছিলনা রাবিয়া বিবির। বিভিন্ন কাজ করে নিজে অর্ধাহারে অনাহারে থেকে দ’ুটি সন্তানকে শিক্ষিত করেছেন তিনি। বর্তমানে তার বড় কন্যা আম্বিয়া খাতুন অর্নাস পাস করে ব্র্যাকে চাকুরী করছেন। ছেলে অনার্স পাস করে নিজ বাড়িতে পানির মেশিন বসিয়ে ব্যবসা করছেন। তাদের সংসারে আর কোন অভাব নেই। এক সময়ে অর্ধাহারে থাকা রাবিয়া বিবি বর্তমানে ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করছেন।
শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সফল নারী রুপা রানী পাল: শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী রুপা রানী পাল। তিনি উপজেলার পারকুমিরা গ্রামের কোমল চন্দ্র পালের কন্যা। তিনি বর্তমানে তালার পাটকেলঘাটা আদর্শ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (বিজ্ঞান) হিসেবে চাকুরীরত আছেন। তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বাবা ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবার আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। তিনবোনের পড়ালেখা আর সংসার সামলাতে গিয়ে তার বাবাকে প্রায়ই হিমশিম খেতে হতো। স্কুল থেকে শুরু করে ইউনির্ভাসিটি পর্যন্ত ভালো একটা জামা ছিল না, ভালো একটা পরার মতো জুতা ছিল না। মা ছিলেন তার গৃহ শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক। বিশ্ববিদ্যলয়ে স্টুডেন্ট থাকাকালীন সময়ে তিনি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হন। মাস্টার্স পাশ করার পরে শিক্ষকতা পেশায় চাকুরী পান তিনি। শিক্ষকতায় পেশায় এসে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রজেক্ট তৈরী, সৃজনশীল মেধা অন্বেষনে অংশগ্রহন, পরীক্ষা প্রদর্শন, গবেষণা, মডেল তৈরী এবং সংগ্রহ, বিজ্ঞান প্রোজেক্ট উদ্ভাবনী, বিজ্ঞানভিত্তিক কুইজ ও প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ, কর্মজীবনে বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মকান্ডের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা ও সহযোগীতা প্রদানে তিনি সর্বদা অগ্রগামী ছিলেন। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি ২০১৯ সালে থাইল্যান্ডের কধংবঃংধৎঃ টহরাবৎংরঃ তে টিচিং সায়েন্স ফর টিটারস প্রোগ্রামে প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। রুপা পাল শিক্ষকতার পেশায় আসতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করেন। সারাজীবন এই পেশায় নিয়োজিত থেকে শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করে তাদের মধ্যে মানব সেবা করার মনোভাব গড়ে তুলতে চান তিনি।
সফল জননী সুচিত্রা দাশ: সফল জননী নারী হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়েছেন সুচিত্রা দাশ। তিনি তালা উপজেলার টিকারামপুর গ্রামের দুলাল চন্দ্র দাসের কন্যা। পিতা-মাতার ৭ সন্তানের মধ্যে তিনি ৪র্থ কন্যা। অসচ্ছল সংসারে অভাব অনটনের ফলে মেধাবী হওয়ার সত্ত্বেও ৮ম শ্রেণির বেশি পড়াশুনা করতে পারেনি সুচিত্রা দাশ। অল্প বয়সেই তার বিয়ে হয়ে যায় এক হতদরিদ্র পরিবারে। সংসারে দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এক কাপড়ে স্বামীর হাত ধরে যশোরের মনিরামপুর ত্যাগ করে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খলিষখালী ইউনিয়নের টিকারামপুর গ্রামে চলে আসেন। সেখানে পরের জমিতে মজুরী খেটে সংসার চালান। স্বামী গ্রাম্য ডাক্তারের প্রাকটিস শুরু করেন। ইতোমধ্যে তাদের দু’টি সন্তান হয়। তার আদম্য ইচ্ছা ছিল সন্তানদের মানুষের মত মানুষ করা। অন্যের কাছে ধার দেনা করে সন্তানদের লেখাপড়া করার তিনি। অবশেষে তাদের স্বপ্ন সত্য হতো শুরু হয়। তার একমাত্র ছেলে শুভংকর দাস, ৪৮ তম বি, সি, এস সুপারিশপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার এবং একমাত্র কন্যা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করেছে। দূর্বিসহ জীবন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি সামাজিকভাবে নিজেকে মেলে ধরেছেন তিনি। সুচিত্রা রানী দাশের অক্লান্ত পরিশ্রমেই এই সাফল্য। সফল জননী এ নারী বর্তমানে পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন। তার দুই সন্তান দেশমাতৃকার সেবায় নিজেদের উজাড় করে দিবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন সফল জননী সুচিত্রা দাশ।
নির্যাতিতা থেকে উদ্যোমী, কর্মঠ ও স্বাবলম্বী নারী ফরিদা বেগম: নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নব উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী ফরিদা বেগম। তিনি তালা ইউনিয়নের বারুইহাটি গ্রামের মোঃ ওয়াজেদ মোড়লের কন্যা। ৪ ভাই-বোনের মধ্যে ফরিদা বেগম সবার বড়। বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা মোটামোটি ভাল ছিল। ৭ম শ্রেণিতে পড়ার সময় মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় তালা সদর ইউনিয়নের শিবপুর গ্রামের আশরাফ হোসেন খাঁ’র সাথে।
স্বামী তেমন কোন কাজ না করায় শশুর বাড়ির লোক তাকে ভাল চোখে দেখাতো না। বিয়ের ২ বছর পরে তার পর পর দুটি মৃত সন্তান হয়। অপয়্যা বলে শশুর বাড়ির লোকের তার উপর নির্যাতন শুরু করে এবং তারা ছেলেকে আবার বিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। এক পর্যায়ে তাদের সংসার থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়। তখন তার স্বামী মাছের ব্যবসা শুর করে। কিছুদিন পর একটি মামলায় জেলে যায় তার স্বামী, তখন এক বছর বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তান ছিল। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে উইমেন জব ক্রিয়েশন সেন্টরে দর্জির প্রশিক্ষণ নেন ফরিদা। তখন প্রশিক্ষণ থেকে পাওয়া ১ হাজার ৫শত টাকা এবং পিতার কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়ে একটি সেলাই মেশিন ক্রয় করেন তিনি। এদিকে স্বামী জেল থেকে বের হয়ে আরেকটা বিয়ে করে। সেখানে ঝামেলা বাধিয়ে আবারও জেলে যান তিনি। পিতার সংসারে থেকে দর্জির কাজের পাশাপাশি একমাত্র মেয়েকে পড়াশুনা করান তিনি। মেয়ে এইচএসসি পাস করার পরে ননদের ছেলের সাথে তাকে বিয়ে দেয়া হয়। মেয়েকে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন পড়াশুনা বন্ধ করে দেয়। তখন ফরিদা তার মেয়ে-জামাইকে নিজ বাড়িতে রেখে পড়াশুনা করাতে থাকে। জামাই অর্নাস পাশ করে একটা কোম্পানীতে চাকরী পায়। তখন জামাই শ্বাশুড়ির কাছে একটা মটরসাইকেল দাবী করে। মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে শ্বশুর বাড়ির জমি বিক্রি করে তাকে মটরসাইকেল কিনে দেয়া হয়। তার পরেও চলতে থাকে মেয়ের উপর নির্যাতন। এক পর্যায়ে মেয়ের ডির্ভোস হয়ে যায়। পরে মেয়েকে নার্সিংয়ে ভর্তি করানো হয়। মেয়ের নার্সিং পড়া শেষ হলে চাকুরী পায় ঢাকায় স্কায়ার হাসপাতালে। চাকুরী পাবার পরে আবারও তাকে বিয়ে দেয়া হয়। নতুন সংসারে ভালো আছে তারা। আর ফরিদা বেগম নিজে দর্জি কাজ করেন। বর্তমানে সুখে শান্তিতে চলছে তাদের সংসার।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন শিরিনা সুলতানা: একজন নারী হয়েও জীবন সংগ্রামের মাঝে সমাজের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন শিরিনা সুলতানা। তিনি উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের মাছিয়াড়া গ্রামের ওয়াজেদ গাজীর কন্যা এবং ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত ইউপি সদস্য। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান শিরিনা ছোটবেলা থেকেই সংগ্রামী ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে এসেছেন। সংসারে দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে এইচ এসসি পাশ করে সমাজ উন্নয়নে নিজেকে নিবেদিত করেছেন। দুই ভাই ও দুই বোনের মধে শিরিনা সবার বড়। বর্তমানে অবিবাহিতা থেকে সমাজসেবা ও মানবকল্যাণকেই জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি। ২০০৩ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো তালা উপজেলার ১২নং খলিলনগর ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য (মেম্বার) নির্বাচিত হন তিনি। টানা তৃতীয় বারের মত নারী সংরক্ষিত ওয়ার্ডে নির্বাচিত হয়ে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন। নিজ উদ্যোগে এলাকায় রাস্তা, কালভার্ট, স্যানিটেশন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেকটা উন্নয়ন ঘটিয়েছেন তিনি। ২০০৫ সালে তালা উপজেলায় শতভাগ স্যানিটেশন কভারেজে তার ভূমিকা দিন প্রশংসনীয়। করোনাকালীন সময়ে এলাকায় সাধারণ মানুষের পাশে থেকে সহযোগিতা করেছেন। নারীর ক্ষমতায়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দর্জি প্রশিক্ষণ, ব্লক-বাটিকের কাজ, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারীর অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি, গর্ভবতী মা ও শিশুদের পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা মুলক কর্মসূচিতে জড়িত তিনি। এছাড়া তিনি ভিজিডি, ভিজিএফ, বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা প্রাপ্তিতে এলাকার দুস্থ মানুষের পাশে থাকেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের পাশাপাশি তার বিভিন্ন অর্জন ও নেতৃত্ব প্রশংসার দাবী রাখে। স্থানীয় সরকার উদ্যোগে ভারতে শিক্ষা সফরও করেছিলেন। একজন সংগ্রামী, দায়িত্বশীল ও মানবিক নারী প্রতিনিধি হিসেবে সীমিত সম্পদ ও প্রতিকূলতার মধে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন তিনি। নেতৃত্ব, সততা, সাহস ও উদ্যামের মাধ্যমে শিরিনা সুলতানা হয়ে উঠেছেন একজন অদম্য নারী, যিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন সমাজ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য। বাকি জীবনও সমাজ উন্নয়নে কাজ করে যাবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।