
বিশেষ প্রতিনিধি : ছাগল-ভেড়া পালন ও শাক-সবজি চাষে পরিবারে স্বামীর পাশাপাশি ভূমিকা রাখছেন সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা। পুরুষনির্ভর হতদরিদ্র পরিবারের নারীরা শাক-সবজি ও ছাগল-ভেড়া পালন করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি জীবনমান উন্নয়নেও সক্রিয় হচ্ছেন। ফলে স্বচ্ছলতা ফিরেছে এসব হতদরিদ্র পরিবারগুলোতে।
দক্ষিণ অঞ্চলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার মাটি লবণাক্ত হওয়ায় হতদরিদ্র পরিবারগুলোর পুরুষরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ এবং ঢাকাসহ বড়শহরগুলোতে রিকশা চালিয়ে ও দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ফলে এসব পরিবারের নারীদের প্রয়োজনীয় কিছু পেতে দিনের পর দিন পুরুষদের ওপর নির্ভর করে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হতো। এই অপেক্ষার পালাকে আরো ভারী করে তোলে প্রতি বছরের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
বর্তমানে দিন বদলের যাত্রায় এসব অঞ্চলের নারীরা এখন পরিবারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার পাশাপাশি সামাজিক অঙ্গনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। এমনকি সন্তানের লেখাপড়ার খরচ বহনও করছেন অনেক নারী। জাতীয় পর্যায়ের একটি অলাভজনক ও অরাজনৈতিক বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা ফ্রেন্ডশিপের সহযোগিতা নিয়ে দুই উপজেলার নারীরা এখন স্বাবলম্বী। অর্থনৈতিকভাবেও সমৃদ্ধ। তারা স্বামীর আয়ের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল না থেকে টুকিটাকি খরচ নিজেরাই বহন করছেন। অনেকেই পুরো সংসারই পরিচালনা করছেন।
ট্রানজিশন ফান্ড প্রজেক্ট (এএসডি)-এর মাধ্যমে আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়ার বিছট, প্রতাপনগরের গোকুলনগর, সোনাতন কাটি, চাকলা এবং শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালী, ঝাপা, সোনাখালী, চন্ডিপুর ও মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মিরগাং, পার্শেখালী, টেংরাখালী গ্রামের জীবনমান উন্নয়নে সক্রিয় গৃহিণীদের ছাগল, ভেড়া, মৌসুমভিত্তি বছরে ২ বার বিভিন্ন প্রকারের শাক-সবজি বীজ এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এসব ছাগল, ভেড়া পালন এবং শাক-সবজি চাষ করে নারীরা স্বপ্ন পূরণে সক্ষম হচ্ছেন।
পদ্মপুকুর ইউনিয়নের সোনাখালী গ্রামের অরুণ মণ্ডলের স্ত্রী পুতুল রানী জানান, স্বামীর উপার্জনের ওপরই নির্ভর করে সংসার চলত। ফ্রেন্ডশিপের এএসডি প্রকল্পের সহযোগিতা নিয়ে প্রথমে বাড়ির অঙ্গিনায় সবজি চাষ করেছিলাম। ফলন ভালো হওয়ায় নিজেরা খাওয়ার পর বাজারে বিক্রয় করে গত বর্ষা মৌসুমে প্রায় ১৪ হাজার টাকা হাতে এসেছে। চলতি শীত মৌসুমে বড় পরিসরে বাড়ির আঙ্গিনাসহ পাশের জমিতে সবজি চাষ শুরু করেছি। এখন সংসারে স্বামীর পাশাপাশি নিজেও অর্থনৈতিক সহযোগিতা করতে পারি। সন্তানের লেখাপড়ার কিছু খরচও দিতে পারি।
একই ইউনিয়নের পাতাখালী গ্রামের আব্দুল ওয়াহিদের স্ত্রী সুফিয়া খাতুন বলেন, অভাবের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির স্বামীর ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। ফ্রেন্ডশিপ এনজিও-এর এএসডি প্রকল্পের সহযোগিতা নিয়ে ছাগল পালন শুরু করে অনেক লাভবান হয়েছি। একটি ছাগল থেকে ১৪টি ছাগলের মালিক হয়েছিলাম। তা থেকে ৪টি ছাগল একসঙ্গে বিক্রি করে বাড়ির পাশের একটি পুকুরে নরম কাঁকড়া উৎপাদনের পয়েন্ট করেছি। স্বামী এবং বড় ছেলের এখন আর সুন্দরবন বা ইটের ভাটায় যেতে হয় না। ফলে আমাদের দরিদ্র সংসার অনেক স্বচ্ছল হয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ইনচার্জ মাহবুর রহমান বলেন, তারা বিনামূল্যে ছাগল-ভেড়া ও হাঁস বিতরণ করছেন। এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। আধুনিক পদ্ধতিতে প্রাণিসম্পদ পালনের প্রশিক্ষণ আমরা ইতোমধ্যে দিয়েছি। এছাড়া যখন যে টিকা আমাদের হাতে আসবে তা দ্রুত দেওয়ার ব্যবস্থা করব। শ্যামনগর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার নাজমুল হুদা এই প্রতিবেদকে বলেন, লবণাক্ত এলাকায় উন্নত জাতের বিভিন্ন প্রকারের শাক-সবজি বীজ বিতরণ করছে ফ্রেন্ডশিপ সংস্থাটি। আমরাও ইতোমধ্যে আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষাবাদের জন্য নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি।
ফ্রেন্ডশিপের প্রজেক্ট ম্যানেজার শহীদুল ইসলাম বলেন, আমরা দুই বছর যাবত একটি পরিবারকে বিভিন্ন সাপোর্ট দিয়ে থাকি এবং পর্যবেক্ষণ করি। তাদের মূলধন গঠনে অবদান রাখার চেষ্টা করি। এখন অনেকই স্বাবলম্বী।
সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার হাটছালা গ্রামে এক সময় শুধু বর্ষা মৌসুমে ধান উৎপাদন হতো। লবণাক্ততার কারণে বছরের অন্যান্য মৌসুমে ফসল হতো না এখানকার মাটিতে। দিনমজুরি দিয়েই সংসার চালাতেন স্থানীয়রা।
কিন্তু এখন দিন বদলেছে। হাটছালা গ্রামেই সারা বছর ফলে নানা ধরনের শাক-সবজি। এতেই ভাগ্য ঘুরেছে অন্তত ১০০ পরিবারের। বছরে তাদের উৎপাদিত সবজির মূল্য প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা।
যদিও সেচের পানির সংকট রয়েছে তাদের। এ সংকট দূর করা সম্ভব হলে আরও ভালো ফসল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে এখানে।
হাটছালা গ্রামের চাষিরা উৎপাদিত ফসল বিক্রি করেন স্থানীয় নকিপুর, বালিয়াডাঙ্গা ও মৌতলা বাজারে। পরে সেখান থেকেই এসব সবজি চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
প্রচণ্ড লবণাক্ততার মধ্যেও হাটছালা গ্রামে প্রায় ৩০ বছর আগে শাক-সবজির চাষাবাদ শুরু করেছিলেন স্থানীয় মনোতোষ মণ্ডল (৬০)। বাড়ির আঙ্গিনায় বারোমাসি সবজির চাষ থেকে ধীরে ধীরে পুরো গ্রামই এখন সবুজে ভরে উঠেছে। ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার ছাড়াই হাটছালা গ্রামে উৎপাদিত হচ্ছে সবজি।
একসময় ফেরি করে হাতের শাঁখা-পলা বিক্রেতা মনোতোষ সবজি চাষ করেই ঘুরিয়েছেন ভাগ্যের চাকা। এখন তিনি ৮০ শতাংশ জমির মালিক।
এক সময় হাটছালায গ্রামে সনাতন পদ্ধতিতে সবজি চাষ হলেও এখন আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষাবাদ করছেন কৃষকেরা।
ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, অনেক কৃষক গ্রিনহাউজ পদ্ধতির আদলে নিজস্ব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছেন। প্লাস্টিকের স্বচ্ছ আবরণ দিয়ে ঢেকে সেখানে বোম্বাই মরিচ, টমেটো, কাঁচা মরিচ, গাজর, লালশাক, বাটিশাক, পালংশাক, ফুলকপি বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন শাক-সবজিতে ভরে উঠেছে ফসলের ক্ষেত।
হাটছালা গ্রামের কৃষক প্রদীপ মণ্ডল জানান, দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি, ওলকপি, লালশাক, টমেটো, পালংশাক, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করেছেন তিনি। গত বছর শীত মৌসুমে সবজি বিক্রি করে আয় করেন প্রায় তিন লাখ টাকা। এ বছর আরও বেশি লাভের আশা করছেন তিনি।
একই গ্রামের কৃষক অনুরুপা মণ্ডল জানান, এক সময় গ্রামগুলোয় নারীরা এতো কাজ করতেন না। তখন সামান্য ধান আবাদ হতো। সে সময় প্রায় প্রতিটি ঘরেই অভাব ছিল। এখন পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও মাঠে কাজ করেন। এ কারণে ১২ মাস সবজি চাষ হয়। এতে অভাবও ঘুচে গেছে এ গ্রামের চাষিদের।
একই এলাকার অনুপ কুমার মণ্ডল জানান, কৃষাণ-কিষাণিরা সমানতালে কৃষি কাজ করছেন। নারীরা ক্ষেত সামলে সংসারের রান্নাসহ ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনার দায়িত্বও পালন করেন। ফসল সংগ্রহ, বাজারজাতকরণ এবং নতুন নতুন সবজি ক্ষেত তৈরিসহ অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন পুরুষরা।
কৃষক মনোতোষ বলেন, সবজি চাষের জন্য খুব বেশি জমির প্রয়োজন হয় না। তুলনামূলকভাবে মূলধনও কম লাগে। পরিশ্রমও অনেক কম। তবে যত্নে ত্রুটি করা যাবে না। কম সময়েই সবজি বিক্রির উপযোগী হয়ে ওঠে। প্রায় প্রতিদিনই বাজারে সবজি বিক্রি করা যায়। পরিবারের চাহিদাও মেটানো সম্ভব। এছাড়া চলতি মৌসুমে সবজির দামও বেশ ভালো। সব মিলিয়ে সবজি চাষকেই আমরা লাভজনক মনে করছি। সবজি চাষ করে ভালো আছে অন্তত ১০০ পরিবার।
তবে তিনি আরও জানান, জমিতে সেচের পানি নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকেন গ্রামের কৃষকরা। বৃষ্টির পানিই একমাত্র ভরসা। বৃর্ষা মৌসুমে ক্ষেতের পাশে পুকুর কেটে সংরক্ষণ করে রাখা বৃষ্টির পানিতেই সবজি চাষ করা হয়। তবে তাতে চাহিদা মেটে না। এজন্য বেশি দামে পাশের গ্রাম থেকে সেচের পানি কিনে সবজি চাষ করেন তারা।
মনোতোষের মত অন্যান্য কৃষকের দাবি, সেচের পানির ব্যবস্থা করা হোক। তাহলে এ গ্রামে আরো ভালো ফসল হবে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, তাদের উৎপাদিত শাক-সবজি উপজেলার চাহিদা পূরণ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর কারণে এখন গ্রাম ঘুরে পাইকাররা ক্ষেত থেকে সবজি সংগ্রহ করে চালান করেন বড় বড় বাজারে।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা বলেন, উপজেলার ভুরুলিয়া ইউনিয়নের (বর্তমান শ্যামনগর পৌরসভা) হাটছালা গ্রামে দেশি সবজি ছাড়াও লবণসহনশীল আলু চাষ হচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় এক হাজার ৩৮৪ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদিত হয় হাটছালা গ্রামে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় পাঁচ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আমরা এখানকার কৃষকদের কারিগরি সহায়তা দিচ্ছি।