
বিশেষ প্রতিনিধি : বাণিজ্যিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পণ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে কাঁকড়া। এরই মধ্যে রফতানিযোগ্য এ কাঁকড়া চাষে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন সাতক্ষীরার চাষিরা। হিমায়িত চিংড়ির মত কাঁকড়াও ইউরোপ ও আমেরিকারসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করে লাখ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে বলে জানায় মৎস্য অধিদফতর।
বাণিজ্যিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পণ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে কাঁকড়া।
সাতক্ষীরা মৎস্য অধিদফতরের দেয়া তথ্য মতে, এ জেলায় বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষ ও রফতানি হচ্ছে ২০১৪ সাল থেকে। এখানে বছরে প্রায় তিন হাজার মেট্রিক টন কাঁকড়া উৎপাদন হয়। এর একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রফতানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে নরম কাঁকড়া রফতানি হয়েছে ৫৬৭ মেট্রিক টন, যার মূল্য ৬৭ লাখ ৩৫ হাজার ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে কাঁকড়া রফতানি হয়েছে ৫১৮ মেট্রিক টন, যার রফতানি মূল্য ৬৯ লাখ ৫১ হাজার ডলার। ২০২১-২২ সালে রফতানি হয় ৮০২ মেট্রিক টন, যার রফতানি মূল্য ১ কোটি ১৬ লাখ ৫১ হাজার ডলার এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ৬২২ মেট্রিক টন, যার রফতানি মূল্য ৮৬ লাখ ৯৮৪ ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৮৭৩ মেট্রিক টন কাঁকড়া যার উৎপাদনায় হয় এক কোটি ৯৯৮ডলার ২০২৪ ২৫ অর্থবছরে ৯৮১ মেট্রিক টন কাকড়া উৎপাদন হয় যা থেকে হায় হায় ১ কোটি ২০ লক্ষ ডলার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে সুন্দরবন নির্ভরতা কমিয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে হ্যাচারিতে কাঁকড়া পোনা উৎপাদনের প্রক্রিয়া চলছে। সাতক্ষীরার সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকার লোনা পানিতে চিংড়ি চাষের পাশাপাশি সফটসেল কাঁকড়া চাষে দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের।
সুন্দরবনের ওপর নির্ভর করে উপকূলীয় এলাকায় গড়ে উঠেছে হাজার হাজার সফটসেল কাঁকড়ার খামার। তবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুমের কারণে প্রতি বছর ৫ মাসের বেশি সময় সুন্দরবনে কাঁকড়া আহরণের পাস বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েন চাষিরা।
জেলার সুন্দরবনসংলগ্ন উপজেলা শ্যামনগরে ৩২০ হেক্টর জমিতে কাঁকড়ার চাষ হয়ে থাকে। সেখানে গত অর্থবছরে দুই হাজার মেট্রিক টন সফটসেল’ কাঁকড়া ও হার্ডসেল কাঁকড়া উৎপাদন হয়। এর মধ্যে জীবন্ত হার্ডসেল কাঁকড়া ও সঙ্গে সঙ্গে সফটসেল কাঁকড়ার সবই বিদেশে রফতানি করে অর্জিত হয় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।
কাঁকড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিকল্প উপায়ে স্বল্পমূল্যে কাঁকড়ার পোনা সরবরাহের পাশাপাশি ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের দাবি চাষিদের।
তারা জানান, অল্প জমিতে কাঁকড়া চাষ করে বেশি লাভবান হচ্ছেন তারা। কাঁকড়ার চাষ করে তাদের সংসারে সফলতা এসেছে। ছেলে-মেয়েদের ভালোভাবে তারা লেখাপড়া শেখাতে পারছেন। তাই কাঁকড়া চাষে তাদের আগ্রহ বেশি।
কাঁকড়া চাষে দরিদ্র জনগোষ্ঠী জড়িত উল্লেখ করে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান জানান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে হ্যাচারিতে কাঁকড়া পোনা উৎপাদন প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। তাতে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে, তেমনি কর্মসংস্থান বাড়বে।
সুন্দরবনের পাড়ঘেঁষা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় এক নতুন সম্ভাবনার নাম ‘সফটশেল’ কাঁকড়া। সুন্দরবনের ছায়াতলে জš§ নেয়া নরম খোসার কাঁকড়া এখন এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে বিপুল জনপ্রিয়তা
পেয়েছে। চিংড়িনির্ভরতা কমে গিয়ে বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কাঁকড়ার চাষাবাদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে চাষযোগ্য কাঁকড়ার মধ্যে শিলা কাঁকড়া অন্যতম। শিলা কাঁকড়া খোলস বদলের সময় প্রায় তিন ঘণ্টা খোলসবিহীন থাকে। তখন কাঁকড়ার ওপর শুধু একটি নরম আবরণ
থাকে। ঠিক সেই সময় কাকড়াঁগুলো বিক্রির জন্য উপযুক্ত হয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে সফটশেল (নরম খোসা) কাঁকড়ার উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়, যার কারণে অনেক চাষি চিংড়ি ছেড়ে এখন কাঁকড়া চাষে ঝুঁকছেন। লাভ বেশি হওয়ায় চাষিরা এখন চিংড়ি চাষ ছেড়ে কাকড়াঁয় আগ্রহ দেখাচ্ছেন বেশি। বর্তমানে শ্যামনগর ছাড়াও সদর ও কালীগঞ্জ উপজেলাসহ অন্যান্য স্থানেও সফটশেল কাঁকড়া চাষ হচ্ছে।
কাঁকড়া চাষে পুকুরের পানির উপরিস্তর ব্যবহƒত হয়, যাতে অব্যবহƒত থাকে পানির নিচের স্তর। পুকুরের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কাঁকড়ার পাশাপাশি সাদা মাছ যেমন রুই, কাতলা ও তেলাপিয়াসহ নানা মাছ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন অনেক চাষি। সফটশেল কাঁকড়া সাধারণত খাঁচা পদ্ধতিতে চাষ হয়, যাতে পানির ওপরে খাঁচাগুলোতে কাঁকড়া চাষ করলে নিচের স্তরের পানিতে সাদা মাছের চাষ করা যায়।
সফটশেল কাঁকড়া দ্রুত প্রক্রিয়াজাত ও রান্না করা যায় বলে আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা বেশি। বর্তমানে সফটশেল কাঁকড়া চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন এশীয় দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
কাঁকড়া শুধু সাতক্ষীরার মানুষের আয়েরই উৎস নয়, বরং কাঁকড়া চাষের মাধ্যমে এই অঞ্চলে মানুষের বেকারত্বও দূর করছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এই কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
সরেজমিনে শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি কাঁকড়ার খামারে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি কাঁকড়ার খামারে কর্মব্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন নারী ও পুরুষরা। কেউ ছোট ছোট করে কাটছেন কাঁকড়ার খাবার তেলাপিয়া মাছ এবং কেউ কেউ নিয়ম করে দেখছেন কাঁকড়ার খোলস পাল্টাচ্ছে কি না। নারীরা মাছ কেটে কাঁকড়ার খাবার তৈরি করেন, আর পুরুষরা খাঁচায় ছাড়েন কাঁকড়া। প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক কাজ করেন এসব খামারে। ফলে উপকূলীয় জনপদে গড়ে উঠছে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ।
শ্যামনগর উপজেলার কলবাড়ী গ্রামের সেলিম হোসেন একসময় ছিলেন নদীনির্ভর জেলে। প্রতিদিন সুন্দরবনের খাল আর আশপাশের নদীতে কাঁকড়া ধরে চলত তার সংসার। কিন্তু অনিশ্চিত আয়ের কারণে পরিবার নিয়ে ছিলেন দারিদ্র্যের ঘেরাটোপে। সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে তার জীবন। এখন তিনি সফল সফট শেল কাঁকড়াচাষি। জেলে থেকে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার এই রূপান্তরের গল্প আজ এলাকার অনেকের অনুপ্রেরণা।
সেলিম হোসেন বলেন, আগে প্রতিদিন নদীতে কাঁকড়া ধরেই সংসার চালাতে হতো। এখন নিজের খামারে কাজ দিচ্ছি স্থানীয় ছেলেদের। এ চাষই বদলে দিয়েছে আমার ভাগ্য। তার খামারে কাজ করছেন বেশ কয়েকজন স্থানীয় যুবক। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি এলাকায় নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহও বাড়ছে।
শ্যামনগরের দুগাবাঁটি এলাকার কাঁকড়া চাষি গৌতম সরকার বলেন, ‘আমাদের এখানে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। তাই আমাদের অর্থনৈতিক একটা ঝুঁকি সব সময় থাকে। চিংড়ি পোনার লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতা কম এবং পোনায় ভাইরাসের আক্রমণে এটি মারা যায়। তাই আমি এবার কাঁকড়া চাষ করেছি। এতে তুলনামূলকভাবে লাভ বেশি হয়। কাঁকড়ার পাশাপাশি পুকুরে সাদা মাছ চাষ করছি, যাতে এটি থেকেও আর্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হওয়া যায়।
একই এলাকার চাষি সৌরভ সরকার বলেন, ‘আমাদের এই অঞ্চলের সবাই সফটশেল কাঁকড়া চাষ করছেন। আমি এই মৌসুমে ৭০০ খাঁচায় তৈরিতে খরচ হয়েছে তিন লাখ টাকা। বাজার ভালো থাকলে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা বিক্রি করতে পারব। বর্তমানে ‘এ’ গ্রেডের সফটশেল কাঁকড়া প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা, ‘বি’ গ্রেডের ৬৫০ টাকা, আর ‘সি’ গ্রেডের ৫০০ টাকা দামে।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে জুন মাসে কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ৭৪ লাখ মার্কিন ডলার। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-জুন) এ রপ্তানি ছিল ৯২ লাখ ৪০ হাজার ডলার, এতে বিগত বছরে চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। শুধু গত জুন মাসে রপ্তানি হয়েছে ১৫ লাখ ৭৭ হাজার ডলার।
জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে শ্যামনগরে ৩৬৪ চাষি প্রায় ৩২১ হেক্টর জমিতে সফটশেল কাঁকড়া চাষ করছেন। বছরে উৎপাদন হচ্ছে ৩ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন কাঁকড়া, যার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্য ৬০০ কোটি টাকা। গত বছর সফটশেল কাঁকড়া রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৮ লাখ ২২ হাজার ডলার। আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে সাতক্ষীরার এ কাঁকড়া।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ আল কায়ূম আবু বলেন, বিদেশি ক্রেতাদের কাছে সাতক্ষীরার কাঁকড়ার মান খুব ভালো। আমরা চাহিদা মেটাতে পারলে আরও বেশি রপ্তানি করা সম্ভব। একসময় চিংড়িই ছিল সাতক্ষীরার অর্থনীতির মূল ভরসা। তবে বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে গেলে বিকল্প খুঁজতে শুরু হয়। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো প্লাস্টিকের খাঁচায় সফটশেল কাঁকড়া চাষ শুরু হয়। এখন সেটিই রূপ নিয়েছে একটি সমৃদ্ধ শিল্পে।সাতক্ষীরা : বাংলাদেশের অতি সম্ভাবনাময় জেলা হিসেবে পরিচিত সাতক্ষীরা। পৃষ্টপোষকতা পেলে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে জেলাটি। এই জেলায় উৎপাদিত চিংড়ী শিল্প বিশ্ব বাজারে রপ্তানী পরবর্তি শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে চলেছে। এখানকার চিংড়ী শিল্প কেবল দেশকে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের মহাক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করছে তা নয় আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশ কে সুনাম, সুখ্যাতি আর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে বলে মনে করেন বিশেজ্ঞরা। সাতক্ষীরা চিংড়ী সহ সাদা প্রজাতির মৎস্যের কারনে শুধুমাত্র দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে তা নয়, এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে সুবাতাস প্রবাহীত হচ্ছে। দেশের সামগ্রীক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সাতক্ষীরার অবস্থান আর অবদান দিনে দিনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াচ্ছে। অর্থনীতির এই সুবাতাস প্রবাহীত হওয়ার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক এই প্রত্যাশা জেলাবাসির।
দেশে মোট রফতানিজাত চিংড়ির একটি বড় অংশ উৎপাদন হয় উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায়। প্রতি বছর আড়াই থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার চিংড়ি রফতানি হয়। গত বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছর রফতানি আয় বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে ২ হাজার ২৫ কোটি টাকা আয় হয়েছে, যা গেল অর্থবছরের তুলনায় অন্তত ১৫০ কোটি টাকা বেশি।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, সত্তর-আশির দশকের দিকে শুরু হয় সাতক্ষীরায় লবণ পানির চিংড়ি চাষ। বাগদা, গলদা, হরিণা, চাকা ও চেম্বিসহ বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি চাষ হয় এখানে। চলতি ২০২৩-২৪ মৌসুমে সাতক্ষীরার ছয়টি উপজেলায় ৫৯ হাজার লবণ পানির ঘেরে বাগদা চিংড়ি চাষ হয়, যা থেকে ২৭ হাজার টন চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদিত এসব বাগদা চিংড়ি থেকে রফতানি আয় হয়েছে ২ হাজার ২৫ কোটি টাকা। মোট উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশ বিভিন্ন দেশে রফতানি হয় এবং বাকি ১০ শতাংশ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ হয়েছে। এর আগে ২০২২-২৩ মৌসুমে জেলায় ২৫ হাজার টন বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হয়েছিল, যা থেকে রফতানি আয় হয় ১ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী চলতি মৌসুমে ১৫০ কোটি টাকা রফতানি আয় বেড়েছে।
সাতক্ষীরা মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুর রব জানান, জেলার উৎপাদিত বাগদা চিংড়ির চাহিদা রয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে। তবে কভিডের সময় রফতানি বন্ধ থাকায় দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও চাহিদা বেড়েছে। এখন দেশের বাজারে বাগদা চিংড়ি ৮০০-৮৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে জুন মাসে কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে ১৩ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-জুন) এ রপ্তানি ছিল ৯ দশমিক ২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, এতে বিগত বছরে চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। শুধু চলতি বছরের জুন মাসে রপ্তানি হয়েছে ১ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ এলাকার কাঁকড়া চাষ করেন আব্দুস সাত্তার। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। তাই আমাদের অর্থনৈতিক একটা ঝুঁকি সব সময় থাকে। চিংড়ি পোনার লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতা কম এবং পোনায় ভাইরাসের আক্রমণে এটি মারা যায়। তাই আমি কয়েক বছর ধরে কাঁকড়া চাষ করেছি। তিনি আরও বলেন, এতে তুলনামূলক লাভ বেশি হয় ও কাঁকড়ার পাশাপাশি পুকুরে সাদা মাছ চাষ করছি, যাতে এটি থেকেও আর্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হওয়া যায়।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার রইচপুর গ্রামের গলদা চিংড়ি চাষি গোলাম মোস্তফা জানান, তিনি এক দশক ধরে মিঠা পানির সাদা মাছের পাশাপাশি গলদা চিংড়ি উৎপাদন করেন। চলতি মৌসুমে ৩০ বিঘা জমির ঘেরে গলদা উৎপাদন করেন। জমির লিজ, রেণু পোনা ক্রয়, খাদ্য ও শ্রমিকের মজুরির টাকা উঠিয়েও ৮ লাখ টাকা লাভ হয়েছে তার। তিনি বলেন, ‘গত মৌসুমেও একই পরিমাণ ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষ করে ৬ লাখ টাকা লাভ হয়েছিল।’
বাংলাদেশ চিংড়ি চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাতক্ষীরার বিশিষ্ট ঘের ব্যবসায়ী আবুল কালাম বাবলা বলেন, গলদা উৎপাদন বাড়াতে হলে এর রেণু পোনা উৎপাদনে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে আগামীতে পোনা সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হবে।
জানা যায়, জেলায় ১ লাখ ৪০ হাজার ৭১ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৪৯ হাজার ২৮৬ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়। যার মধ্যে ৬৭ হাজার ৬শত ৮৩ হেক্টর জমিতে ৪০হাজার ৯শত ১১ মেট্রিক টন বাগদা ও গলদা ও অন্যান্য চিংড়ি মাছের উৎপাদন হয়। জেলার চাহিদার থেকে প্রায় দ্বিগুণ উৎপাদন মাছ বেশি হয়।
মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলায় ৫৪ হাজার ৩শত ৫৮ মেট্রিক টন মাছের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ২শত ৮৬ মেট্রিক টন। যা জেলার চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপাদন হয়েছে ৯৪ হাজার ৯শত ২৭ মেট্রিক টন বেশি।
জানা যায়, জেলার ৫৪ হাজার ৯শত ৩৫টি জলাশয়ে ৫৮ হাজার ২শত ৯৪ হেক্টর জমিতে ২৬ হাজার ২শত ১৪. ৯৯ মেট্রিক টন বাগদা চিংড়ি মাছের চাষ হয় ও ১১ হাজার ৬শত ৬২টি জলাশয়ে ৯ হাজার ৩ শত ৮৯ হেক্টর জমিতে ১০ হাজার ২০৪ মেট্রিক টন গলদা চিংড়ি চাষ হয়। এবং অন্যান্য নদী ও বিভিন্ন জলাশয়ে ৪ হাজার ৪শত ৯৩ মেট্রিক টন ছোট বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি মাছের চাষ হয়। ৩৬৪টি কাঁকড়া ঘের এ ৩ শত ২১ হেক্টর জমিতে ১ হাজার ৯শত ৬৫ মেট্রিক টন কাঁকড়া উৎপাদন হয়। ও সাতক্ষীরা জেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদের ৪৩ জায়গারও ১৩শ ২৬ সেক্টর জায়গায় ১হাজার হাজার ৫শত ২১ মেট্রিক টন বিভিন্ন মাছ উৎপাদন হয়, জেলার বিভিন্ন খাল ও বিলের ৪শত ৬টি জায়গার ৩ হাজার ২শত ৫ হেক্টর জমিতে ১৪ হাজারহ ১শত ৭৩ মেট্রিক টন বিভিন্ন মাছ উৎপাদন হয়, জেলার বিভিন্ন বাওড়ের চারটি স্থানের হেক্টর জমিতে ২শত ৪ মেট্রিক টন মাস উৎপাদন হয় এবং জেলার সুন্দরবন পয়েন্টের একটি নদের ৫৫হাজার ৫শত২৪হেক্টর আয়তনে২হাজার ২শত ৫৯ মেট্রিক টন মাস উৎপাদন হয় এবং জেলার বিভিন্ন ধান ক্ষেতের ভিতরে ৩হাজার ৫ হেক্টর জমিতে ২ হাজার ৪ মেট্রিক টন মাস উৎপাদন হয় এবং বারোপিট এলাকার ২শত ৫৮ হেক্টর জমিতে ১শত ৭৫ টন মাছ উৎপাদন হয়, রং বিভিন্ন স্তানের বিলের জমিতে ঘেরসহ অন্যান্য জলাশয় মিলে ৪০ হাজার ৬শত ৫৪ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়। মাছের সাথে সাথে জেলা থেকে ১শত ৯ মেট্রিক টন কুচিয়া উৎপাদন হয় যার দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাইরে রপ্তানি করা হয়। এবং সরকারিভাবে ১শত ৯৩টি পুকুরের ৪৮ হেক্টর জমিতে ২শত ৮৫ মেট্রিক টন বিভিন্ন জাতের মাছ উৎপাদন করা হয়, ও বিলের ভিতরে ছোট নার্সারি চারা মাছ ৩৯ মেট্রিক টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদন হয়।সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় এবার ৩১৪ হেক্টর জমিতে কাঁকড়ার চাষ করা হয়েছে। মাত্র সাত বছর আগেও সাতক্ষীরায় জেলায় কাঁকড়ার চাষ হতো মাত্র ৫০ হেক্টর জমিতে। সে হিসেবে সাত বছরে জেলায় কাঁকড়ার চাষ বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ। সাতক্ষীরা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বছরই বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষ বাড়ছে। অল্প জমিতে স্বল্প বিনিয়োগে কাঁকড়া চাষ তুলনামূলক সহজ ও লাভজনক হওয়ার কারণে প্রান্তিক চাষিরা এ কাজে ঝুঁকছেন। তা ছাড়া ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কারণে বাগদা চাষে ব্যাপক ক্ষতি চাষিদের কাঁকড়া চাষে আগ্রহ বাড়াচ্ছে। কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন পর্যাপ্ত হলে সাতক্ষীরায় কাঁকড়া চাষের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিত বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলার কাঁকড়া চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মড়ক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চিংড়ি মাছ উজাড় হওয়ায় কাঁকড়া চাষে ঝোঁক বেড়েছে তাঁদের।
শ্যামনগরের কাঁকড়া চাষি অরিন্দম দাস বলেন, আমি ১০ বিঘা জমিতে বাগদা চাষ করতাম। কিন্তু প্রতিবছরই লাভের বদলে ক্ষতি হতো বেশি। ক্ষতির কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রতিবছরই ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় ঘের। ফলে মাছ ভেসে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির শিকার হতে হয়। তা ছাড়া চিংড়ির পোনার লবণ সহনীয় ক্ষমতার ভারসাম্য না থাকা ও ভাইরাসে বাগদা মরে উজাড় হয়ে যায়। তাই তিনি এখন ছয় বিঘা জমিতে কাঁকড়া চাষ করছেন।
একই এলাকার রায়হান মল্লিক জানান, আমাদের এখানে বেশির ভাগ খাঁচা পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষ করা হয়। বিদেশে সফট শেল কাঁকড়ার চাহিদা বেশি। ৭০০ খাঁচায় কাঁকড়া চাষ করতে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় প্রায় পাঁচ লাখ টাকায়।
কলবাড়ি এলাকার ব্যবসায়ী শ্যামল পাল জানান, এ বছর কাঁকড়ার চাষ বেশ ভালো। এ গ্রেডের কাঁকড়া বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায়। বি গ্রেডের ৬৫০ এবং সি গ্রেডের কাঁকড়া বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। এখানকার কাঁকড়া সাধারণত ইউরোপ, আমেরিকা ও চীনে রপ্তানি করা হয় বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
তবে সুন্দরবন থেকে ধরে আনা কাঁকড়ার পোনা দিয়ে ঘেরে চাষ হয়। বছরের বেশ কিছু দিন জেলেদের ওপর সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকে। বিশেষ করে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ও জুন-জুলাইয়ে সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরা নিষিদ্ধ থাকে। এ কারণে সে সময় সমস্যায় পড়তে হয় চাষিদের।
সার্বিক বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিএম সেলিমবলেন, ‘সাতক্ষীরায় কাঁকড়া চাষ সম্ভাবনাময় একটা খাত। সফট শেলের চাহিদা বেশি। কাঁকড়া প্রসেসিং প্ল্যান্ট রয়েছে শ্যামনগরে, যার মাধ্যমে কাঁকড়া সরাসরি বিদেশে যাচ্ছে। ঝুঁকি কম বলে অনেকেই এ চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তবে সমস্যা হলো পোনা নিয়ে।’
তিনি বলেন, ‘চাষিদের পোনা সংকট কাটাতে হ্যাচারি স্থাপন প্রয়োজন। সরকারিভাবে দেশে শুধু কক্সবাজারে হ্যাচারি রয়েছে। আমরা বেসরকারিভাবে হ্যাচারি স্থাপনে উৎসাহিত করছ
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিএম সেলিম এই প্রতিবেদককে বলেন, সাতক্ষীরা জেলা দেশের ভিতরে মৎস্য চাষে মডেল হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। এ জেলা থেকে তিন ভাগের দুই ভাগ চিংড়ি মাছ বিদেশে রপ্তানি হয়। আমরা মৎস্য চাষীদের আধুনিকরণে সর্বদা সহযোগিতা করে থাকি।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিএম সেলিম এই প্রতিবেদককে আরো বলেন, দেশে-বিদেশে সফটশেল কাঁকড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যদি স্থানীয়ভাবে হ্যাচারি স্থাপন করা যায়, তাহলে এ শিল্প আরও বড় পরিসরে সম্প্রসারিত হবে এবং বৈদেশিক আয়ও বহুগুণে বাড়বে। তিনি বলেন, শ্যামনগর উপজেলার মাত্র দুটি ইউনিয়নেই রয়েছে ৩৬৫টি বাণিজ্যিক খামার। বছরে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় দুই হাজার টন কাঁকড়া, আর কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষের।