
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সাতক্ষীরার কৃষিতে। জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, এরই মধ্যে উপকূলীয় এ জেলার ফসল মৌসুমের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে।
দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সাতক্ষীরার কৃষিতে। জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, এরই মধ্যে উপকূলীয় এ জেলার ফসল মৌসুমের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। এছাড়া অনাবৃষ্টি, খরা, কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতাসহ মাটি ও পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে। পাশাপাশি অসময়ে শীত ও বৃষ্টির কারণে ফসলহানি দেখা দিচ্ছে। এতে ধান, গম, পাট ও মৌসুমি সবজিসহ অন্যান্য দানাদার-জাতীয় ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সাতক্ষীরা কার্যালয়ের সর্বশেষ জরিপে সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষিজমিতে ২৫ থেকে ৩৫ ডিএস পর্যন্ত লবণের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা এ জেলার কৃষির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সাতক্ষীরা জেলায় কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে। উপকূলীয় এলাকার মাটি ও পানিতে ব্যাপকভাবে লবণাক্ততা বাড়ছে। এছাড়া মৌসুমি আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এ জেলায় ফসলি মৌসুমের পরিবর্তন ঘটেছে।
তিনি বলেন, ‘সময়মতো শীত না আসার কারণে শীত মৌসুমের ফসল যেমন গম, ছোলা, মসুরসহ অন্যান্য শাক-সবজি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অগ্রহায়ণ বা পৌষ মাসের শীত ফাল্গুন বা চৈত্র মাসে দেখা দিচ্ছে। এতে এ ফসলগুলোর মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। মৌসুমি শীত না পড়লে সবজি বা অন্যান্য ফসলের পুষ্টিগুণ থাকে না, তেমনি ফলনও ভালো হয় না।’
ব্রি সাতক্ষীরা কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজ্জাদুর রহমান জানান, দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য লবণাক্ততা ও বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে টিকে থাকতে পারে এমন ১৫ হাজার ধানের গবেষণা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে সাতক্ষীরার চারটি উপজেলায়। উপজেলাগুলো হচ্ছে সাতক্ষীরা সদর, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পার্টনার প্রকল্পের অধীনে এসব জাত উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা কার্যক্রম চলছে।
তিনি জানান, বন্যা ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু বেশকিছু জাত আবিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে বন্যাসহিষ্ণু ব্রি-ধান ৯১ ও ১১১ আমন, যা দেড় মিটার বন্যার পানিতে টিতে থাকতে পারবে। এর ফলন হেক্টরপ্রতি চার টন। এছাড়া লবণাক্ততাসহিষ্ণু ব্রি-ধান ১১২ আমন এবং বোরো মৌসুমের জন্য লবণাক্ততাসহিষ্ণু ব্রি-৬৭, ৯৭ ও ৯৯ জাত। এসব জাত উচ্চ লবণাক্ততা সহ্য করতে পারবে, যার উৎপাদন হেক্টরে ছয় থেকে সাড়ে ছয় টন পর্যন্ত। এ কয়েক প্রজাতির ধান এরই মধ্যে সাতক্ষীরা জেলায় চাষ শুরু হয়েছে।
ড. সাজ্জাদ আরো বলেন, ‘সম্প্রতি এক জরিপে জেলার কালিগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলার কৃষিজমিতে ২৫ থেকে ৩৫ ডিএস পর্যন্ত লবণাক্ততার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়া অন্যান্য উপজেলায় ১৪ থেকে ২২ ডিএস পর্যন্ত লবণের উপস্থিতি মিলছে, যা এ জেলার কৃষিতে মারাত্মক হুমকির কারণ। আর এ ভয়াবহ লবণাক্ততার কারণে তাদের গবেষণা কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান তিনি।’
জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি ও পানিতে মারাত্মক লবণাক্ততা দেখা দেয়ায় কৃষকরা বাধ্য হয়ে এসব এলাকার কৃষিজমিতে লোনাপানির মৎস্যঘের করছেন। এছাড়া অসময়ে অতিবৃষ্টির কারণে কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। চলতি মৌসুমে জেলায় সাড়ে ১২ হাজার হেক্টর আমন ও আউশ ধানের জমি সম্পূর্ণ পানিতে তলিয়ে আছে। তবে এ জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে আরো পাঁচ বছর আগে থেকে।
এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও জার্মানির যৌথ উদ্যোগে সাতক্ষীরা জেলায় লবণাক্ততাসহিষ্ণু বিভিন্ন জাত উদ্ভাবনে ব্যাপক গবেষণা শুরু করা হয়েছে। এরই মধ্যে এ জেলার জন্য বেশকিছু লবণাক্ততাসহিষ্ণু ফসল আবিষ্কার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সাতক্ষীরা কার্যালয়ের দায়িত্বরত প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিমুল মণ্ডল জানান, উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, যার নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে কৃষিতে। ফসলি জমিতে ও পানিতে অতিমাত্রায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ লক্ষ্যে সাতক্ষীরার এ বৈরী আবহাওয়ার পরিবেশে টিকে থাকতে পারে এমন ফসল উদ্ভাবনের জন্য জার্মানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘টেকসই লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা উপকূলীয় কৃষি বাস্তুতন্ত্রে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট প্রক্রিয়া বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের অধীনে বারি-১৬ ও ১৭ জাতের মিষ্টি আলু উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপকভাবে চাষ করেছেন কৃষক। এটি হেক্টরপ্রতি ২২-২৩ টন পর্যন্ত উৎপাদন সম্ভব।
তাছাড়া কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সাতক্ষীরার পক্ষ থেকে বেকিছু লবণাক্ততাসহিষ্ণু ফসলের জাত আবিষ্কার করা হয়েছে। যেমন, সূর্যমুখী বারি-২ ও ৩, মুগডাল বারি-৬, মিষ্টি আলু বারি-১৬, বারি বার্লি-৮ এবং অত্যন্ত পুষ্টি সমৃদ্ধ কিনুয়া বারি-১। এসব ফসল ৮ থেকে ১২ ডিএস পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যক্ষ আশেকী এলাহী জানান, একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যদিকে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে লোনাপানি উঠিয়ে চিংড়ি চাষের কারণে জেলার কৃষি খাতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। জেলায় ৭৮-৭৯ হেক্টর জমিতে আমন ও বোরো ধান চাষ হয়। সেখানে ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে লোনাপানি তুলে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। চিংড়ি চাষ পরিবেশ ও কৃষির জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, ‘চিংড়ি উৎপাদন করতে গিয়ে জেলার অন্য সব ফসল হারিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া হাজার হাজার কৃষি শ্রমিক বেকার হয়ে গেছেন। ৫০ বিঘার জমিতে ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন করতে অন্তত ১০০ শ্রমিকের কাজের সুযোগ হয়। সেখানে ৫০ বিঘার চিংড়ি ঘেরের জন্য দুজন শ্রমিকই যথেষ্ট। ফলে একদিকে বহুমাত্রিক ফসল হারিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে শ্রমিকরা কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন।’
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর বিলে জলাবদ্ধতার কারণে দেড়-দুই হাজার বিঘা জমিতে এবার আমন ও আউশ ধান চাষ করতে পারেননি কৃষকরা। বুকসমান পানিতে এ ফসলি বিল ডুবে আছে। কৃষক বাবু হাজি, আব্দুল খালেক ও জাফর কারিগর জানান, তাদের একেকজনের ১০ থেকে ১২ বিঘা করে জমি রয়েছে রামচন্দ্রপুর বিলে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে মারাত্মক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় কোনো ফসল উৎপাদন করতে পারেন না তারা। অথচ পাঁচ বছর আগেও তারা এ বিলে প্রতি বিঘায় ২০-২২ মণ ধান উৎপাদন করেছেন।
তারা আরো জানান, পাঁচ বছরের ব্যবধানে জলাবদ্ধতা গ্রাস করেছে তাদের কৃষিজমি। বিলে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় ফসল উৎপাদন করতে পারছেন না তারা। কোমরসমান পানিতে টিকে থাকতে পারে, সরকারের কাছে এমন জাতের ধানের বীজ দেয়ার দাবি জানিয়ে তারা বলেন, ‘অন্যথায় আমাদের মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।’
জেলার আশাশুনি উপজেলার গোনাকরকাটি গ্রামের মৎস্যচাষী আব্দুল বারি জানান, তার গ্রামের শতভাগ কৃষিজমিতে এখন লোনাপানির মৎস্যঘের। এক দশক আগেও হাজার বিঘা জমিতে ধান ও পাটসহ বিভিন্ন ফসল ফলত। কিন্তু ক্রমান্বয়ে মাটি ও পানিতে অতিমাত্রায় লবণাক্ততা দেখা দেয়ায় তাতে কোনো ফসল হচ্ছে না। ফলে কৃষকরা বাধ্য হয়ে লোনাপানির মৎস্য চাষে চলে যাচ্ছেন।
এদিকে সবজি উৎপাদনে জেলায় শীর্ষে থাকা তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের অধিকাংশ চাষের জমি পানিতে তলিয়ে আছে। গত বছর এ সময় আগাম শীতকালীন সবজি ফুলকপি ও পালংশাকসহ অন্যান্য সবজি চাষ করলেও চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত মাটি প্রস্তুত করতে পারেননি কৃষকরা।
ইউনিয়নের নগরঘাটা গ্রামের সবজিচাষী রুহুল আমিন বলেন, ‘তিন বিঘা জমির গ্রীষ্মকালীন সবজির খেত অতিবৃষ্টির কারণে তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আশা করেছিলাম আগাম শীতকালীন সবজি চাষ করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত জমিতে পানি রয়ে গেছে। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে সবজি চাষ।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় উপপরিচালক সরদার শরীফুল এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সাতক্ষীরা জেলায় দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে। এ জেলায় কখনো খরা-অনাবৃষ্টি আবার কখনো অতিবৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া জলোচ্ছ্বাস ও মাটি-পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে, যা এ জেলার কৃষির জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে এখনই জাতীয়ভাবে বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে আগামীতে জেলার ফসল উৎপাদনে মারাত্মক ক্ষতি হবে।’
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর সাতক্ষীরা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জুলফিকার হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সাতক্ষীরা অঞ্চলের আবহাওয়ায় দ্রুত পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ৭৯৮ মিলিমিটার, ২০২৪ সালের একই মাসে রেকর্ড হয় ৩৯১ মিলিমিটার আর ২০২৩ সালের জুলাইয়ে রেকর্ড করা হয় ২২৯ মিলিমিটার। এ হিসাব অনুযায়ী তিন বছরের ব্যবধানে জেলায় বৃষ্টিপাত বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। পাশাপাশি এ সময় বজ্রপাত ও বজ্রসহ ঝড়ও ব্যাপকভাবে বেড়েছে।’ তবে বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতির কোনো পরিসংখ্যান তার দপ্তরে নেই বলে জানান।