সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: সুন্দরবনে দস্যু দমনের সূচনা হয়েছিল ২০১৬ সালে। সে বছর সবচেয়ে বড় দল ‘মাস্টার বাহিনী’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেয় এবং পুনর্বাসনে রাজি হয়। এর পরপরই আরও ৩২টি দস্যু বাহিনীর প্রধানসহ মোট ৩২৮ জন দস্যু আত্মসমর্পণ করে, জমা পড়ে ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪ রাউন্ড গুলি। সরকার এরপর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করে। মনে করা হয়েছিল, বহু বছরের ভয়ঙ্কর দস্যুতার অবসান ঘটল। কিন্তু সেই অর্জন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সুন্দরবনে এখনও বেপরোয়াভাবে চলছে দস্যুতা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে সুন্দরবনে ফের ডাকাতদের উৎপাত শুরু হয়। মুক্তিপণ দিয়ে ফেরা জেলেদের অভিজ্ঞতা ও কোস্টগার্ডের তথ্য মিলিয়ে দেখা যায়, দেশি-বিদেশি অস্ত্র হাতে অন্তত ১৬টি দস্যু বাহিনী আবারও সুন্দরবনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মজনু, রাঙ্গা ও ছোট সুমন, করিম শরীফ, দয়াল (বাগেরহাট), রবিউল, মামা-ভাগনে (বাগেরহাট), আসাবুর, দুলাভাই, আল-আমিন, জাহাঙ্গীর, আফজাল, কাজল-মুন্না, বাহিনী নামে পরিচিত এই দলগুলো মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশে জেলেদের অপহরণ করছে। এসব বাহিনীর সদস্যরা আগেও দস্যূতায় যুক্ত ছিলেন। আত্মসমর্পনের মধ্যদিয়ে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। তবে গনঅভ্যূত্থানের পর তারাই আবার অস্ত্র হাতে বনে দস্যুতায় যুক্ত হয়েছে। নিপীড়ন চালাচ্ছে বনের ওপর নির্ভরশীল জেলে বাওয়ালীদের ওপর।
বন বিভাগ, কোস্টগার্ড ও পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে কারাগার ভাঙচুর করে পালানো কয়েদিরাও দস্যুতায় যুক্ত হয়েছে। যেমন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রামের আবদুল্লাহ তরফদার নারী পাচারের মামলায় কারাগারে ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট সাতক্ষীরা জেলা কারাগার ভাঙার সময় তিনি পালিয়ে যান এবং পরে সুন্দরবনে প্রবেশ করে নতুন বাহিনী গঠন করেন। তাঁর সঙ্গে আছেন আরও ১০/১২ জন, যাদের অধিকাংশই কারাগার থেকে পালানো।
আত্মসমর্পণকারী সাবেক দস্যুরাও আবার অস্ত্র হাতে ফিরেছেন। কয়রার কুখ্যাত দস্যু আল আমিন আত্মসমর্পণ করেছিলেন্ কিন্তু গত এপ্রিলে অস্ত্রসহ কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পড়েন। জামিনে বেরিয়ে আবার দস্যুতায় নামেন তিনি। একইভাবে ২০১৮ সালে আত্মসমর্পণকারী করিম শরীফও ফের বনে সক্রিয়। স্থানীয়রা জানান, আত্মসমর্পণকারী মিলন পাটোয়ারী এখন মজনু বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত। এমনকি খোকাবাবু নামের সাবেক দস্যুও আবার সক্রিয় হয়েছেন।
আসাবুর বাহিনীর প্রধান আসাবুর সানা গত বছরের নভেম্বর মাসে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তখন তিনি কোস্টগার্ডের নৌকায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন ডাকাতি করবো।’ পরে তিনি কথাও রেখেছেন। জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি আবারও অস্ত্র হাতে বনে প্রবেশ করেন বলে জেলেরা জানিয়েছেন। চলতি বছরের আগস্টে শিবসা নদীতে তাঁর অবস্থানের খবর পেয়ে কোস্টগার্ড অভিযান চালায়। আসাবুর পালিয়ে গেলেও তার দলের দু’জন আটক হয় এবং উদ্ধার করা হয় একনলা বন্দুক, গুলি ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম।
জেলেদের সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতায় তিন বাহিনী দস্যুতা শুরু করেছে। এসব বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে মামলা প্রত্যাহার, আর্থিক অনুদানসহ নানা সুযোগ সুবিধাও তাদের দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর তারা ফের দস্যুতায় ফিরেছেন। তিন বাহিনীর মধ্যে আত্মসমর্পণ করা মজনু বাহিনীর প্রধান মজনু নিজেই এখন তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মজনু প্রথম দস্যুতায় ফিরে যান। তার দেখাদেখি আলিম, মিলন পাটোয়ারী ও রবিউল পশ্চিম সুন্দরবনের পূর্বপ্রান্তে দস্যুতা শুরু করে। আর দাকোপ, মোংলা ও নলিয়ান এলাকায় দস্যুতা শুরু করে আসাবুর বাহিনী।
সুন্দরবনে দস্যুদের হাতে কীভাবে অস্ত্র পৌঁছায় তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আত্মসমর্পনের পর এ প্রতিবেদকের কথা হয় বনদস্যু মজনুর সাথে। সেসময় তিনি বলেছিলেন, দেশের বাইরে থেকে চোরাই পথে বন্দুক আনা হয়। সুন্দরবনে যার কাছে যত ভারি অস্ত্র সে তত শক্তিশালী। এসব অস্ত্র শহরের লোকেরাই আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়। এছাড়াও কিছু অস্ত্র লোকালে তৈরি করা হয়। সেগুলোকে স্থানীয় ভাষায় বলে ঠেলা বন্দুক। একই সাথে এয়রগানের বডিতে মোটা পাইপ ফিট করেও তৈরি করা হয় বন্দুক। যেগুলো জেলেদের ভয় দেখানোর জন্য। যদি কখনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে পড়ে যেতে হয় তখন শুধু ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
দস্যুদের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে অস্ত্র কিনে চোরাই ভাবে নদী পথে সেগুলো পৌঁছে দিত সুন্দরবনে। এসব অস্ত্রের মূল যোগানদাতা ছিলেন বাচ্চু ওরফে ব্ল্যাকার বাচ্চু। ৫ আগস্টের পর সুন্দরবনে যত ডাকাত প্রবেশ করেছে তাদের বড় অংশের অস্ত্র সরবরাহ করছে ব্লাকার বাচ্চু ও জাকির। বাচ্চুর ইন্ডিয়া থেকে চোরাই মালামালের ব্যবসাও রয়েছে। নৌ রুটে এসব চোরাই পন্য আনা নেওয়া নির্বিঘ্ন করতে সুন্দরবনের নীলকোমল ও অন্য একটি নতুন চরে জেলে ঢুকিয়েছে। নীল কোমল ফরেস্ট অফিসের এক কর্মকর্তাকে মোটা অংকের অর্থ দিয়ে বাচ্চু জেলেদেরকে চোরাচালানের কাজে লাগিয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া মাসুদ ও মজনু দস্যু দলগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। মজনুর নামে একটি দস্যু দল বনে থাকলেও সে থাকছে লোকালয়ে। তার আয়ের অন্যতম মাধ্যম অস্ত্র বিক্রি। মজনুর বাড়ি খুলনার দৌলতপুরের দেয়ানায়। সেখানে তার আলীশান বাড়িও রয়েছে।
দস্যুর কবল থেকে মুক্ত হয়ে ফেরা জেলে দাকোপের মিনারুল ইসলাম বলেন, আসাবুর আমাকে উঠিয়ে নিয়েছিলো। আমি একটি নৌকায় একজন সহযোগী নিয়ে গিয়েছিলাম কাঁকড়া ধরতে। ৩০ হাজার টাকা দিয়ে তবেই আমাকে ফিরে আসতে হয়েছে।
একইভাবে কথা বলেছেন দস্যু দল থেকে ছাড় পাওয়া কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের আনারুল ও আসমাউল সানা। তারা বলেন, আমরা কার্ড সংগ্রহ করতে না পারায় মজনু বাহিনী আমাদেরকে তুলে নিয়েছিলো মার্চ মাসে। ৫০ হাজার টাকা দিয়ে আমাদের ফেরত নিয়ে এসেছে পরিবার।
তবে সুন্দরবনে দস্যুতা বাড়লেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা একেবারেই কম। বিশেষ করে দস্যু আত্মসমর্পনে র্যাব ব্যাপক ভুমিকা রাখলেও এখন নিষ্ক্রিয়।
এ বিষয়ে খুলনার পুলিশ সুপার টিএম মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা খবর পেলেই অভিযান পরিচালনা করি। দস্যুদের ধরতে গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যহত রয়েছে।’
কোস্টগার্ডেও দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে ১৮ জন দস্যুকে গ্রেপ্তার এবং ১৬টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২২৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ১২টি।
কোস্টগার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়াম-উল-হক বলেন, ‘একসময় দস্যুতা বন্ধ হয়েছিলো সুন্দরবনে। বর্তমানে ফের সক্রিয় হয়েছে দস্যু বাহিনীগুলো। তাদের দমনে কোস্টগার্ড নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। অনেক অপহৃতকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বনকে ফের দস্যুমুক্ত করা হবে।’