
বিশেষ প্রতিনিধি : অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে ডুবছে রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর। সাতক্ষীরা ,খুলনা ,বাগের হাট ,পিরোজপুর ,ঝালকাঠি ,বরিশাল, বরগুনা ,ভোলা, লক্ষীপুর, চাঁদপুর ,ফেনী ,নোয়াখালী ,কুমিল্লা ,চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এই সমস্ত উপকূলীয় জেলাগুলিতে জোয়ারের পানি স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে প্রতিনিয়ত ৩ থেকে ৫ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ঝুঁকিতে রয়েছেন সার্বক্ষণিক প্রায় ২কোটি মানুষ। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের কালকিনি গ্রাম
‘জোয়ারের অতিরিক্ত চাপ এখন আমাদের বড় শত্রু। জোয়ারের পানিতে আমাদের এলাকার ফসলি মাঠ, বাড়িঘর, রাস্তা ডুবে যাচ্ছে। প্রতিদিন দুইবার জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর ডুবছে। জোয়ার ঠেকাতে না পারলে এই অঞ্চলে মানুষ বসবাস করতে পারবে না।’
কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার বাত্তিরখাল এলাকার মাকসুদ আলম, ৪৫। জোয়ারের পানিতে তার ঘর ডুবে যায় বারবার।
এই এলাকাটি গত দু’দিন ধরে জোয়ারের পানিতে ডুবছে। কমলনগর উপজেলা কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে নদী ভাঙনের মুখে। প্রতি বছর এই উপজেলার বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। অনেকেই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। মেঘনা নদীর তীরে বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানি প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিচ্ছে এই এলাকায়। আন্তর্জাতিক জোয়ার মনিটরিং প্রতিষ্ঠান টাইড ফোরকাস্ট বলছে, আরো দুই-একদিন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জোয়ারের পানি থাকবে।এবং জোয়ারের পানিতে ডুববে এই এলাকা।
মাকসুদ আলমের মতো আরো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তাদের সমস্যা নিয়ে। তারা বলেন, ‘বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়ে আমরা সবকিছু হারাচ্ছি। প্রতি বছর আমাদের কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত করে। নদীর ভাঙন তো অব্যাহতভাবে চলছেই। ঋণ করে আমরা আর কতদিন চলবো?’
বাত্তিরখাল এলাকার খুব কাছের গ্রাম কালকিনি। এই গ্রামের বাসিন্দা ফাহিমা বেগম, ৩৫, জোয়ারের সময় নিজের বাড়ি ছেড়ে এলাকার উঁচু একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। জোয়ারের পানিতে ফাহিমা বেগমসহ ওই এলাকার আরো অনেকের ঘর ডুবে যায়। জোয়ারের পানির কারণে তাদের জীবন-জীবিকায় সংকট বেড়ে যায়। জোয়ারের সময়ের সাথে তাল রেখে তারা দৈনন্দিন কাজ করেন। ফাহিমা বলেন, ’আমাদের অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ নাই। সে কারণে এখানে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছি। নদী আমাদের বাড়ির খুব কাছে এগিয়ে এসেছে। খুব বেশিদিন আর এখানে বসবাস করতে পারবো না।’
জোয়ারের চাপ এখন শুধু কমলনগরের জন্য নয়; বাংলাদেশের গোটা উপকূলের জন্য এটা এখন বড় সঙ্কট। মনসুনে বেশ কয়েকবার জোয়ারের পানি বাড়ে। মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়, মানুষ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। চলতি বছর জুলাইয়ে বর্ষাকালে উচ্চ জোয়ারের চাপে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দুর্গাবাটি গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। ফলে খোলপেটুয়া নদীর পানি প্রবল বেগে ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এক সপ্তাহের মধ্যে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার হয়; কিন্তু অনেকেই ক্ষতির মুখে পড়েন। কিন্তু এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা কোনো সাহায্য পাননি।
মেঘনা নদী ছাপিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকেছে লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের বাত্তিরখালে
শ্যামনগর উপজেলার দূর্গাবাটি গ্রামের গীতা রানী মন্ডল বলেন, ‘আমার কাঁকড়া খামারসহ বাড়িঘর জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। কাঁকড়া খামারে আমার ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। আমরা ক্ষুদ্র চাষি। বারবার এত ক্ষতির ঘাটতি আমরা পূরণ করতে পারি না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের ঋণ নিতে বাধ্য করছে। আমরা বছরের পর বছর ঋণের বোঝা বহন করি।’
স্বপনচন্দ্র হাওলাদার এবং গীতা রানী মন্ডলের মতো ওই এলাকার আরো বহু চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন চলতি বছর বর্ষায়।বাংলাদেশের দক্ষিণপশ্চিম উপকূলের মানুষ ২০০৭ সালের সাইক্লোন সিডর, ২০০৯ সালে আইলা, ২০১৯ সালে ফণী, একই বছর বুলবুল, ২০২০ সালে আম্ফান, ২০২১ সালে ইয়াস-এ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। এ কারণে ওই এলাকায় ঝুঁকি বেড়েছে।
বর্ষায় পূর্ণিমার প্রভাবে বাংলাদেশের সমগ্র উপকূল অঞ্চলে জোয়ারের পানি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। উপকূলের সব নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপকূলের সমুদ্র রেখার নিকটবর্তী বহু গ্রাম জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। ফলে প্লাবিত এলাকার বাসিন্দাদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বহু পরিবার বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
জোয়ারের পানি ঢুকেছে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে অবস্থিত তিনটি বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশালেও। উপকূলে অবস্থিত কয়েকটি জেলা শহরেও জোয়ারের পানি ঢুকেছিল। নিচু এলাকার বহু গ্রাম অন্তত শতাধিক দ্বীপ পানিতে ডুবে যায়।চট্টগ্রাম মহানগরীর চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, নিমতলী, ফকির হাট, গোসাইলডাঙ্গা, শান্তিবাগ এলাকা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়।জোয়ারের সময় কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি দেখা যায়। বাসাবাড়ি, দোকানপাটে পানি ঢুকে যাওয়ায় ঘরের আসবাবপত্র এবং দোকানের মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। পানির সঙ্গে নালা-নর্দমা থেকে উঠে আসা ময়লা-আবর্জনায় সয়লাব হয়ে গেছে এলাকা। এতে চরম দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল হোসেন জানান, ‘আগে জোয়ারের পানি উঠত। কিন্তু এবার যে পানি উঠেছে তা অস্বাভাবিক। জোয়ারের পানির জন্য চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের।’
এবার মনসুনে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পানিতে বরিশাল নগরীর নিম্নাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয় কয়েকবার। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়কেও পানি ওঠে। নগরীর বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক, সাংবাদিক মাইনুল হাসান সড়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পানির নিচে চলে গিয়েছিল কয়েক দফায়। শহরের পলাশপুর, ভাটিখানা ও হাটখোলাসহ সদর উপজেলার চরবাড়িয়া, চরকাউয়া এলাকায়ও নদীর পানি ঢুকে পড়েছিল। জোয়ারের সময় বহু মানুষ ঘরবন্দি থাকতে বাধ্য হয়।
জোয়ারের পানিতে প্লাবিত ফসলি মাঠ। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের বাত্তিরখাল এলাকার ছবি
দ্বীপ জেলা ভোলার মেঘনা নদীতে জোয়ারের পানি এবারের বর্ষায় অনেক উচ্চতায় প্রবাহিত হয়েছে। মেঘনা নদীর তীরবর্তী চরনিজাম, কলাতলীর চর, চরযতিন, চরজ্ঞান, চরফ্যাশনের কুকরিমুকরি, ঢালচর, চরপাতিলা, মাঝেরচর, চরশাহজালাল, কচুয়াখালীর চর সহ ২০টি চর প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত হয়ে পড়েছিল কমপক্ষে ২৫ হাজার মানুষ।
এবারের বর্ষায় উচ্চ জোয়ারে বরগুনা জেলার তালতলীতে পায়রা নদীর তেঁতুলবাড়ী এলাকার ১০০ মিটার বেড়িবাঁধ ধ্বসে ৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ৫০টি খামারের মাছ ভেসে যায়। গ্রামীণ রাস্তা তলিয়ে গিয়েছিল জোয়ারের পানিতে। বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে অন্তত ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল।
বাংলদেশের উপকূলের লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার ক্ষয়ে যাওয়া দ্বীপ তেলির চর। এই দ্বীপটি গত তিন বছর ধরে উচ্চ জোয়ারে ডুবছে। এখানে দশ বছর ধরে বসবাস করছেন আলাউদ্দিন মাস্টার। উচ্চ জোয়ার তার জীবন ও জীবিকায় চরম সংকট সৃষ্টি করেছে। ‘আমাদের ঘরটি এই দ্বীপের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ভূমিতে বানানো। ঘরের ভূমি দশ ফুট উঁচু করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও আমার ঘরে এবার জোয়ারে পানি ঢূকেছে।’ বলেন আলাউদ্দিন।
লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর উপজেলার মারটিন গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা কোরবান আলী বলেন, ‘আমরা নদীর তীরের মানুষ। নদীর সাথেই আমরা বসবাস করি। ৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে নদীতে মাছ ধরি। অমাবস্যা-পূর্ণিমায় জোয়ার আসে। কিন্তু এত উচ্চ জোয়ার কখনো দেখিনি। পানি বাড়লে আমাদের জীবনযাপনে খুব সমস্যা হয়। ভবিষ্যতে নদীর তীরে আমরা বসবাস করতে পারবো কিনা জানি না।’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মেঘনা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ারের অতিরিক্ত পানি খুব সহজে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। এতে নদী ভাঙনসহ উপকূলীয় বাসিন্দাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ সময় কমলনগর উপজেলার কালকিনি, সাহেবেরহাট, পাটারীর হাট, চর ফলকন, চর মার্টিন, চর লরেঞ্চ ইউনিয়ন এবং রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার, বড়খেরী, চরগাজী, চর আবদুল্লাহ ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রামে জোয়ারের পানি উঠেছিল।
দ্বীপ জেলা ভোলার মেঘনা তীরবর্তী গ্রাম বলরাম সুরা ডুবেছে জোয়ারের পানিতে। এই গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি সিরাজ উদ্দিন বলেন, ‘জোয়ারের পানি যাতে ঘরে ঢুকতে না পারে, সেজন্য বাড়ির ভূমি দশ ফুট উঁচু করেছিলাম। তারপরও গত দুই বছর ধরে আমাদের ঘর পানিতে ডুবছে। এখানে আমরা আর বসবাস করতে পারবো না।
কমলনগরের কালকিনি ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মেহেদি হাসান লিটন বলেন, ‘জোয়ারের পানি আমাদের এলাকার জন্য এখন বড় সমস্যা। প্রতি জোয়ারে নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।জোয়ারের কারণে নদীর ভাঙনও বাড়ছে। এলাকার মানুষ এখন খুবই অসহায়। জোয়ার এবং নদীর ভাঙন দুইটি বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি এই এলাকার মানুষ। বেড়িবাঁধ না হওয়া অবধি এলাকার মানুষ এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবে না।’
কালকিনি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘প্রকৃতির কাছে আমরা অসহায়। আমাদের ইউনিয়নের দক্ষিণ অংশ নাই। অনেক আগেই নদীতে হারিয়ে গেছে। অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে এলাকার মানুষের সংকটের শেষ থাকে না। বহু মানুষ ক্ষতির মুখে পড়ে। অনেক বাড়িতে দুপুরে রান্না হয় না। মানুষের ভোগান্তির শেষ নাই।’
ঘূণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরা উপকূলের অনেক এলাকার বেড়িবাঁধ মেরামত করতে না পারায় এখন পর্যন্ত প্লাবিত লোকালয়ের মধ্যেও জোয়ার-ভাটা চলছে। ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে আপামর জনতাকে। স্থানীয় মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে রিং বাঁধ নির্মাণের কাজও চলছে। তবে বড় ঢল নামলে স্রোতে তা ভেসে যাবে বলেই মনে করছেন স্থানীয়রা। তারা মনে করছেন, দ্রুত স্থায়ী ও টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা না হলে নদীগর্ভে বিলীন হবে উপকূলের অনেক গ্রাম।
জানা গেছে, ঘূণিঝড় আম্পানে শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, পদ্মপুকুর, কাশিমাড়ি, মুন্সিগঞ্জ ,আটুলিয়া, রমজান নগর ,কৈখালী ও আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ও প্রতাপনগর ইউনিয়নের অধিকাংশ বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়। বাঁধগুলো স্থানীয় মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করার উদ্যোগ গ্রহণের কয়েক বছর অতিবাহিত হলেও অনেকে এলাকায় এখনও বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয়নি। একমাত্র শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নে ১০৪০ কোটি টাকা ব্যয় সরকার একটি টেকসই মজবুত ভেড়িবাদের মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছেন যাহার কাজ চলমান রয়েছে ।আবার অনেক এলাকায় এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণ করা হলেও নদীর প্রবল জোয়ারের চাপে ভেঙে গেছে। এতে করে এখনও সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কাশিমাড়ি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা ও পদ্মপুকুরের বন্যতলা বুড়ি গোয়ালিনী মুন্সিগঞ্জ আটুলিয়া রমজান নগর ও আশাশুনির প্রতাপনগর ও শ্রীউলার লোকালয়ে জোয়ারের পানি ঢুকছে মাঝে মাঝে ।এদিকে দেবহাটার সীমান্ত নদী ইছামতির বাঁধ ভেঙে অন্তত পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়। এছাড়া তালার পাখিমারা বিলের টিআরএম বাঁধে ভেঙে কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
আশাশুনির প্রতাপনগর ইউপি এই প্রতিবেদককে জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সাতক্ষীরার মধ্যে বাঁধ ভেঙে তার ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৪০ কিলোমিটার বাঁধের সব নষ্ট হয়ে হয়েছিল। আম্পানে খোলপেটুয়া নদীর চাকলা, দিঘলারআইট, সুভদ্রাকাটি, রুইয়ারবিল, কুড়িকাহুনিয়া, হিজলিয়া কোলাসহ বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। স্থানীয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রিং বাঁধ দেওয়া হলেও প্রবল জোয়ারে অধিকাংশ বাঁধ বেঙে এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। এখনও নদীতে জোয়ার হলে ইউনিয়নের বিভিন্ন লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে, ভাটায় সেই পানি নেমে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁশ ও বস্তা দেওয়া ছাড়া কোনও সহযোগিতা করেনি। চাকলা, কুড়িকাহুনিয়া, হরিষখালি পয়েন্টে বড় বড় ভাঙন দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। দ্রুত স্থায়ী টেকসই বাঁধ নির্মাণ না করলে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে এই হারিয়ে যাবে প্রতাপনগর ইউনিয়নসহ উপকূলের অনেক এলাকা।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবছর জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ ভেঙে আশাশুনি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ১৯৯৫ সালে আশাশুনির বলাবাড়িয়ায় বাঁধ ভাঙার পর থেকে প্রতিবছর ভাঙনের কবলে পড়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হলেও কাজ হয় না। পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে নাকাল হয়ে পড়ে এই জনপদের মানুষ। ঝড়ে ক্ষয়-ক্ষতি না হলেও বেড়িবাঁধ ভেঙে জীবন ও সম্পদ হারায় তারা। অনেক মানুষ বাঁধের ওপর ছাপড়া তুলে মানবেতর জীবনযাপন করছে।’
শ্যামনগরের কাশিমাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান আনিসজ্জমান আনিস বলেন, ‘আম্পানে খোলপেটুয়া নদীর ৬টি পয়েন্টে ২ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে পুরো ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছিল। কিন্তু ছোট ছোট দুটি স্থান ছাড়া ভেঙে যাওয়া অধিকাংশ স্থানের বাঁধ মেরামত করা হয়েছে। পরে স্থানীয় মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে রিং বাঁধ দেওয়া হলেও জোয়ারের পানিতে চিংড়িখালি খালের চার ফিট বাঁধ ভেঙে পুরা ইউনিয়ন আবারও মাঝে মাঝে প্লাবিত হয়। এখনও এলাকায় জোয়ার-ভাটা হচ্ছে। কাশিমাড়ি ইউনিয়নের ঝাঁপালির চিংড়িখাল ও খোলপেটুয়া নদীর ওয়াপদা বাঁধের ১০টি গ্রামের এবং কালিগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের তিন গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে হয়েছিল। ফলে নদীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে রীতিমতো জোয়ার-ভাটার মধ্যে বসবাস করছে উপকূলীয় দুর্গত জনপদের হাজারও পরিবার।
গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, আম্পানের পর লেবুবুনিয়া, নাপিতখালি ও জেলেখালি এলাকায়র বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এই ইউনিয়নের মোট ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ২০ কিলোমিটার ভেঙে যায়। এলাকারবাসীকে সঙ্গে নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে রিং বাঁধা হয়েছিল।
পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসএম আতাউর রহমান জানান, আম্পানে তার ইউনিয়নের বন্যতলা, কামালকাটি, ঝাপা, ছোট চন্ডীপুর, পূর্ব পাতাখালি, পশ্চিম পাতাখালি, খুঁটিকাটা ও চাউলখোলা পয়েন্টগুলোর বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। মোট ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ২৪ কিলোমিটার ভেঙে যায়। এসব এলাকার বাঁধগুলো স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে পানি ঠেকাতে রিং বাঁধ দেওয়া হয় প্রথমে পরে পর্যায়ক্রমে পানি উন্নয়ন বোর্ড বস্তা ড্যাম্পিং সহ মেরামতের কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে বন্যা তলার বাঁধ ভেঙে কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তাই সবার আগে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ সংস্কার জরুরি। নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলেই যে কোনও মুহূর্তে রিং বাঁধ ভেঙে আবারও এলাকা প্লাবিত হবে।