
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : শক্তির দেবী, ভক্তির দেবী, মঙ্গল ও কল্যাণের দেবী হিসেবে সু-প্রাচীন যুগ থেকে আত্মপীড়িত মানুষের কাছে পুজিত হয়ে আসছেন বিশ্বখ্যাত যশোরেশ্বরী কালীমাতা। ইতিহাস ঐতিহ্যে সমুর্জ্জল ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক শক্তিপীঠ মন্দির রূপে খ্যাত বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার ঈশ্বরীপুরে অবস্থিত যশোরেশ্বরী কালীমাতা মন্দির। হিন্দু সনাতনী ধর্মীয় সংস্কৃতিতে আপন শক্তি বলে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে তন্ত্র সাধনা। সাধারণ শক্তির সাধকগণ তান্ত্রিক হিসেবে বিবেচিত হন। কালীরূপী নারী শক্তি যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন নামে মানুষের কাছে শক্তি ও মঙ্গলের দেবী রূপে পুজিত হয়ে আসছেন।
যশোহরের পীঠ মন্দির: প্রসিদ্ধ যশোরেশ্বরী কালীমাতা শক্তির দেবী হিসেবে দেশবিদেশে বিখ্যাত। যশোরেশ্বরী কালীমূর্তি, তিনি আবক্ষ দৃশ্যমান, লোলো জিহবাধারি, সাধারণ কালী অপেক্ষা একটু ভিন্ন এবং দেখতে ভয়ংকরী। তিনি মধ্যযুগীয় যশোহর রাজ্যের রাজা প্রতাপাদিত্যের পীঠ দেবতা।
যশোরেশ্বরী উপমহাদেশের একটি অন্যতম পীঠ মন্দির এবং দর্শনীয় স্থান। তাঁর কীর্তি ও মন্দির নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাস ঐতিহ্য এবং ইতিকথা। দেশ-বিদেশের বহু পূর্ণাথী, তীর্থাথী যুগ যুগ ধরে এ পীঠস্থানে গমনাগমন করে থাকেন। বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন সুন্দরবন জনপদের সাতক্ষীরা জেলার ঈশ্বরীপুরে অবস্থিত যশোরেশ্বরী কালী মায়ের মন্দির এটি ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীনতম পীঠ মন্দির।
নামের উৎপত্তি: লোকজ কাহিনী মতে যশো নামে এক পাটনী এই ঈশ্বরী নামীয় দেবীকে যমুনা পারাপার করাকে কেন্দ্র করে কালে কালে এখানকার দেবীর নাম হয় যশোরেশ্বরী। যে স্থানে দেবীর মন্দির বিদ্যমান,বর্তমানর সে স্থানে নাম ঈশ্বরীপুর, প্রবীন মানুষরা আজও বলেন যশোর-ঈশ্বরীপুর। আর এই যশোরেশ্বরী মায়ের নাম থেকে যশাের নামের উৎপত্তি হয়েছে।এই পীঠস্থানের কথা দেশ বিদেশের বহু ভক্ত-জ্ঞানীগুণী অবগত থাকলেও সময় ও প্রেক্ষাপটের কারণে বর্তমানে অনেকেরই এই যশােরেশ্বরী মন্দির এবং মায়ের প্রতিষ্ঠা ও অবস্থান সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই।
যশোহর নামের পত্তন: যশোরেশ্বরী নাম থেকে যশোহর নামের পত্তন হয়েছে। মধ্যযুগে বারো ভুঁইয়ার অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের সময়ে এই সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। বাংলাভাষা চর্চা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি, বাঙালি চেতনা জাগরণের অন্যতম স্থান ছিল এই আদি যশোহর রাজ্য। এ অঞ্চলের ড্যামরাইল নবরতœসভা, গোপালপুর গোবিন্দদেব মন্দিরসহ নানা প্রতœ নিদর্শন কীর্ত্তণ যুগের কবিদের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার স্বাক্ষ্য বহন করে।
যশােরেশ্বরী দেবী কীর্তি নিয়ে যুগে যুগে ইতিহাস ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি জেগেছ, আবার রঙ্গভরা বঙ্গদেশের লোকমুখে বহু কিংবদন্তি তৈরি হয়েছে। আমরা ইতিহাস এবং পৌরাণিক কাহিনীর আলোকে প্রাচীন ভারতীয় দেবী যশোরেশ্বরী মাতার কথা বলছি।
পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী শক্তিমান দেবতা শিবের লীলাসঙ্গিনী সতীর দেহের একান্ন খ-ের একখন্ড পতিত হওয়ার পর তাঁকে কেন্দ্র করে সেই সুপ্রাচীনকাল থেকে মাতা যশােরেশ্বরীর আর্বিভাৰ এবং এই অঞ্চলে পুজিত হচ্ছেন। ইনি যশােরের পীঠদেবতা হিসেবে সর্বত্রই পরিচিত হন। পৌরাণিক ব্যাখ্যা মতে প্রলয়ের দেবতা শিব মৃত্যু সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে তা-ব নৃত্য করাকালে; স্থিতির দেবতা ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্রদ্বারা ব্যবচ্ছেদ করলে সতীরদেহ ৫১ খ-ে বিভক্ত হয়ে প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে পতিত হয়।
অবস্থান: বঙ্গপোসাগর উপকূল প্রাচীন পু-্রদেশের ব্যঘ্রতটী ভুক্তি জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে এ অঞ্চলকে বুড়োন দ্বীপ বলা হতো। মধ্যযুগে মোঘল শাসনামলে এই যশোরেশ্বরী কালী মাতার নামানুসারে যশোহর রাজ্য বা যশোর দেশ হিসেবে পরিচিত হয়। বর্তমানে স্থানটি সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামে অবস্থিত। এটি ৫১ পীঠের একটি হিসেবে পরিচিত। পৌরাণিক মতে সতীর দেহ নিয়ে শিবের তা-ব নৃত্যকালে বঙ্গোপসাগর উপকুলে পড়ে সতীমাতার হাতের পাঞ্জা বা পানিপদ্ম।
“যশোরে পানিপদ্মঞ্চস্য দেবতা যশােরেশ্বরী। চ-শ্চৈভৈরবস্তর যত্রঃ সিদ্ধি¤্রাপ্লায়াৎ ‘তন্ত্রচুড়ামণি’।।
পানিপদ্ম বলতে হাতের তালুকে বােঝানো হয়। এখানে দেখা যায় প্রাচীন তন্ত্রচুড়ামণি গ্রন্থে যশোর নামের উল্লেখ রয়েছে। মধ্যযুগীয় বারোভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী যশােহর বা বর্তমান যশোরেশ্বরীপুর নামক স্থানে, বঙ্গপসাগর ঘেষা সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদে।
ইতিহাসের আলোকে যশোহর: ইতিহাসের আলোকে জানা যায়, মোগলদের আক্রমনের মুখে গৌড়ের শেষ পাঠান সুলতান দাউদ খান কররাণীর পরাজয় ও পাঠান শাসনের অবসান হলে সেখানকার পদস্থ রাজকর্মচারী শ্রীহরি ও জানকী বল্লভ পরাজিত পক্ষের লোকলস্কর, ধনসম্পদ নিয়ে নদী পথে আত্মগোপনে লক্ষ্যে গৌড় থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম এই বিচ্ছিন্ন বিপদসংকুল জনপদ সুন্দরবনে এসে জঙ্গল কেটে বর্তমান কালীগঞ্জ উপজেলা ইছামতি-কালীন্দির সন্নিকটে এক স্থানে বসতি স্থাপন করে বসন্তপুর নাম নিয়ে আবাসস্থল গড়ে তোলেন। এর কাজকাছি স্থানে গড়মুকুন্দপুর (বর্তমান কালিগঞ্জে) নামক স্থানে পরিখা বেষ্টনী রাজকীয় দুর্গ নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। পাশাপাশিজনবসতি গড়েতোলেন, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন।এই জনপদে এসে শ্রীহরি ও জানকী বল্লভ বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় নাম ধারণ করে বসবাস শুরু করেন এবং ‘যশোহর সমাজ’ নামে সমাজ গঠন করেন।
তাঁরা এ অঞ্চলে অধিষ্ঠিত প্রাচীন শক্তির দেবী যশোরেশ্বরীর নাম অনুসরণ করে নতুন এই জনপদের নামকরণ করেন যশােহর পরগণা বা যশোহর রাজ্য। নতুন রাজ্য পরিচালনার জন্যে বিক্রমাদিত্যকে রাজা হিসেবে ঘােষণা দেয়া হয়। আর প্রাজ্ঞ, দূরদর্শী বসন্ত রায় রাজ্য রক্ষার কাজে নিয়োজিত হন। তিনি যেমন ছিলেন যোদ্ধা, তেমনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ ভাবুক-কবি এবং সামাজিক মানুষ। তাঁরই আগ্রহে তৎকালে যশোহর সমাজ, ড্যামরাইল নবরতœসভা মন্দির, গোপালপুর গোবিন্দ দেব মন্দির, ৯৯ বিঘা জমির উপর খননকৃত দীঘি নির্মিত হয়।
প্রতাপাদিত্য: বিক্রমাদিত্যের পুত্র প্রতাপাদিতা রাজা হওয়ার পর (আনুমানিক ১৫৮৭ খ্রি:) যমুনা ও ইছামতির সঙ্গমস্থলে জঙ্গল কাটনাের এক পর্যায়ে যশোরেশ্বরীর কষ্টিপাথরের মূর্তি ও ভগ্ন মন্দির আবিষ্কৃত হয়। রাজা প্রতাপাদিত্য কালীমাতাকে কুলদেবতা হিসেবে বরণ করেন এবং ঈশ্বরীপুরে মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রাজ্যভার গ্রহণ করার পর বাবা-কাকা প্রতিষ্ঠিত পরিখা বেষ্টিত গড়মুকুন্দপুর দূর্গ-রাজধানী স্থানান্তর করে মায়ের মন্দির সংলগ্ন স্থানে যশোহর রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তর করত: (বারোদুয়ারি) নির্মাণ করে রাজকার্য পরিচালনা করেন।
মন্দিরের প্রাচীনত্ব: যশোরেশ্বরী কালী সম্পর্কে কবিরাম কৃত দিগি¦জয়প্রকাশ নামক প্রাচীন গ্রন্থ হতে জানা যায়, ‘পুর্বাকালে অনরি নামক একজন ব্রাক্ষ্মণ দেবীর জন্য এখানে শতদ্বারযুক্ত এক বিরাট মন্দির নির্মাণ করেন। পুনরায় ধেনুকর্ণ নামক এক ক্ষত্রিয় নৃপতি তীর্থ দর্শেন আসিয়া মায়ের ভগ্ন মন্দির স্থলে এক নতুন মন্দির প্রস্তুত করিয়া দেন। সুন্দরবনের ইতিহাসে দেখিয়াছি যে, সুন্দরবন বহুবার উঠিয়াছে পড়িয়াছে। কখনো এখানে জনকোলাহলময় লোকালয় ছিল; কখনো তাহা উচ্চন্ন হইয়া মনুষ্যশুন্য হইয়াছে। (সতীশচন্দ্র মিত্র, যশোহর খুলনার ইতিহাস দ্বিতীয় খ-)।
রাজা প্রতাপাদিত্য যশোরেশ্বরী কালী মায়ের একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন। তিনি তার রাজ্যের রাজগুরু কমলনয়ন তর্কপঞ্চাননের মাধ্যমে শক্তি মন্ত্রে দীক্ষিত হন। কথিত আছে মায়ের বরে প্রতাপাদিত্য বহু যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেন। লোকে তাঁকে যশোরেশ্বরী কালীর বরপুত্র বলতো।
বারো ভুঁইয়ার অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্য যশোহর রাজ্য শক্তিশালী করে যশোহরকে স্বাধীন রাজ্য আর নিজকে স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। মানসিংহ সহ একাধিক মোঘল সেনাপতির সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়। সর্বশেষ সুবেদার ইসলাম খাঁর শাসন কালে ১৬১০ খ্রি: যুদ্ধে রাজা প্রতাপাদিত্য পরাজিত হন।
পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রভাব প্রাকৃতিক দূর্যোগসহ নানা কারণে জনবসতি ধ্বংস হয় এবং অঞ্চলটি জনশুন্য হয়ে পড়ে ফলে যশোরেশ্বরী কালী মায়ের মন্দির অরক্ষিত ও একপ্রকার বিনষ্ট হয়।
পরবর্তীতে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ওই অম ফের জনবসতি গড়ে উঠে। এই কালে পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের মাধ্যমে মন্দির প্রচীনত্বের স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
মন্দিরের বর্ণনা: বর্তমানে মন্দিরটি ১৮ জোড়া খাম্বা খুটির উপরে দ-ায়মান। এটি একটি অনিন্দ্য সুন্দর নবরতœ মন্দির। (দুই ধাপে চারটি করে আটটি এবং চুড়ায় একটি রত্ম) উপরে একটি গােল প্রধান চুড়া গম্বুজ, মন্দিরটি চতুষ্কোণী চারপাশে বারান্দা।উত্তর-দক্ষিণপাশে একই সমস্তরালে দু’টি দরজা এবং পশ্চিমপাশে মায়ের দর্শনীয় সদর দরজা মন্দির চত্বরের পশ্চিম। উত্তর ও দক্ষিণপার্শ্বের পুরাতন নহবৎ খানা, অতিথিশালা, দর্শনার্থীদের কক্ষ ভেঙ্গে পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে, সম্ভবত এগুলি ১৯ শতকের দিকে বর্তমান সেবায়িতগণের পুর্বপুরুষগণ অতীতের আঁদলে পুন:সংস্করণ বা নির্মাণ করেন।
প্রাচীনত্ব: মহাস্থানগড়ের মাটি খুঁড়ে আবিষ্কৃত হয়েছে পুর্বভারতের জনবসতি সর্বপ্রাচীন পু-্র/পৌ-্র সভ্যতার নিদর্শন। পু-্র জনপদ খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছরের অধিক পুরাতন; এটি মহাভারতীয় কালের জনপদ। মধ্যযুগীয় যশোহর রাজ্য বা সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদ প্রাচীন পু-্র রাজ্যের ‘ব্যঘ্রতটী ভূক্তি’জনপদ। এ অঞ্চলের যশোরেশ্বরীও অতি প্রাচীনতেœর স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। প্রতাপাদিত্যের রাজধানী যশােহর নগরীতে শুধুমাত্র যশােরেশ্বরী শােভাবর্ধন করতো তা নয়। তার শাসনামলে এখানে আরাে কয়েকটি উপাসনালয় গড়ে উঠেছিল যার অবস্থান প্রায় একই সমান্তরালে। এদের একটি ট্যাংগা মসজিদ (বর্তমানে শাহী মসজিদ) অন্যটি উপমহাদেশের প্রথম যীশু খৃষ্টের গীর্জা। প্রায় দু’কিলোমিটার পশ্চিমে গোপালপুর গ্রামে গোবিন্দদেব মন্দিরমালা। (আজও ভগ্নস্তূপ বিদ্যমান)। প্রতাপের সেনাবাহিনীতে হিন্দু, মুসলিম ও খৃষ্টান সৈন্য ছিলেন। তাদের জন্য পৃথক পৃথক উপসানালয় করে দেয়া হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন। প্রতাপের পদাতিক বাহিনী অন্যতম প্রধান ছিলেন খাজা কমল, কতলু খাঁসহ অনেক মুসলমান সৈন্য। এঁদের প্রার্থনার জন্য যশােরেশ্বরী মায়ের মন্দিরের পশ্চিমপাশে উক্ত ট্যাংগা মসজিদ নির্মিত হয় ।
বর্তমান জনবসতি গড়ে উঠার পর আনুমানিক ১৯৩০-৪০ এর দশকে ঝোপজঙ্গল ও ইটমাটির স্তুপ পরিস্কার করে উক্ত পাঁচগম্বুজ বিশিষ্ট লম্বা মসজিদ আবিস্কৃত হয়। পরবর্তীতে এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণের প্রচেষ্টায় পুরাতন অবয়বের ভীত দেয়াল ঠিক রেখে ট্যাংগা মসজিদটি সংস্কার করা হয়। (তবে প্রতœত্বাত্বিক নিয়ম মানা হয়নি) এখানে প্রায় ১৪ হাত লম্বা একাধিক কবর ছিল বর্তমানে সেগুলি সংস্কার করে দু’টি কবর পাকা করা হয়েছে। এই মসজিদের পূর্বপাশে সমসাময়িক কালে নির্মিত হাম্মামখানা বা হাফসিখানা ভঙ্গুর অবস্থায় আজও দাঁড়িয়ে আছে।এর পুর্বপাশ্বে ছিল রাজদরবার। কালীমায়ের মন্দিরের পূর্বপাশে ছিল উপমহাদেশের প্রথম গীর্জা। প্রতাপের নৌ সেনাবাহিনীতে ডুডলী, রডার প্রমুখ বীর ছিলেন। এদের দৌলতে জেসুইটস পাঁদ্রীগণ প্রতাপের অনুমতি নিয়ে তাঁদের উপসনালয় নির্মাণ করেন ১৫৯৯ খ্রি: এবং এটিই ছিল মধ্যযুগীয় বঙ্গদেশের প্রথম গীর্জা। ১৬০০ খ্রিঃ ১ জানুয়ারিতে রাজা প্রতাপাদিত্যের উপস্থিতিতে পাঁদ্রীগণ জাঁকজমক সহকারে গীজা উদ্ধোধন করেন। এটির নাম দেয়া হয়েছিল যীশু খৃষ্টের গীর্জা। প্রতাপের পতনের পর উক্ত গীর্জা আর কোন সংস্কার না হওয়ায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে সে স্থানে বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে।
১৯৯৯ খ্রি: এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহকালে (শিল্পী গাজী গোলাম মোস্তফা আমার সাথে ছিলেন) ঈশ্বরীপুর গ্রামের অশিতিপর বৃদ্ধ সাবেক চেয়ারম্যান কিনু সরদার গীর্জার অবস্থান আমাদের দেখিয়েছিলেন তাঁদের কলা খেতের মধ্যে, তখনও সেখানে পুরাতন ভীত ও প্রচুর ভগ্ন সেই যুগের ইট ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
যশোরেশ্বরী মন্দিরের সর্বশেষ অবস্থা:
মন্দির পুন:প্রতিষ্ঠা: প্রতাপের পতনের পর মন্দিরটি দীর্ঘ বৎসর অরক্ষিত ছিল। শোনা যায়, মাঝে মাঝে দু:সাহসিক দস্যুরা অবস্থান করে মায়ের পূজা দিতেন,পরে কিছু সাহসী হিন্দু মুসলমান বসবাস শুরু করে এই স্থানে। অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগে বর্তমান আধিকারীদের পূর্বপুরুষ জয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ব্যবসায়িক কাজে মধ্যযুগের প্রসিদ্ধ এ অঞ্চলে আসেন। এ সময় স্থানীয় অধিবাসীদের মুখে যশােরেশ্বরী মায়ের কথা শুনে তাদের অনুরোধে ঈশ্বরীপুরে বসবাস শুরু করেন এবং সেই সময় থেকে মায়ের পূজা অর্চনা শুরু হয় বলে ধারণা করা যায়। শ্রী সতীশ চন্দ্র মিত্র বলেছেন, জয়কৃষ্ণের প্রপৌত্র বিষ্ণরাম বা তার পুত্র বলরামের সময়ে ইংরেজদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত শুরু হয়। এই বলরামই মায়ের মন্দির এক প্রকার নতুন করিয়া নির্মাণ করেন।এ বিষয়ে উল্লেখ্য ‘১৭৩১ শাকে অর্থাৎ ১৮৩৯ খ্রি: চৈতলী চট্টোবংশীয় পূরন্দরের সন্তান বলরাম বিপ্র এই কালীকাপুরী নির্মাণ করিয়া মায়ের সেবা ও সম্পত্তি ভ্রাতুস্পুত্র কালীকিঙ্করের হাতে সমৰ্পণ করিয়া স্বাগত হন।
কালীকিঙ্কর ১৮৪৪ খ্রি: (১৭৬৬ শাকে) এই লিপি সংযুক্ত করেন বাংলালিপিতে ইহাই স্পষ্টকৃত হইয়াছে-‘বঙ্গাব্দ বারো শ’ ষােল সাল পরিমান
শ্রী মহা কালীকাপুরী করিয়া সুনির্মাণ।
চৈতালীয় চট্রোবংশ পূরন্দর সন্তান।
ক্ষিতিসুর বলরাম মহামতিমান,
যে কিছু বিষয় সেবা অধর্মের অপিএ।
আনন্দে আনন্দ থামে আইন বসিএ,
তাহার জ্যৈষ্টের সুত শ্রী কালীকিঙ্কর,
বারো শ’ একান্ন সালে লিপিতত্ত্বপর।” (তথ্য সুত্র ও যশোহর খুলনার ইতিহাস ২য় খন্ড পৃষ্ঠা-২৮৫ )
বংশধারা: কাশ্যপ গােত্রীয় জয়কৃষ্ণের ৪র্থ অধস্থন ছিলেন বলরাম। বলরামের বড় ভাই দেবী প্রসাদের পুত্র কালীকিঙ্কর। পরবর্তীতে দেখা যাচ্ছে, বলরামের তৃতীয় অধস্থন জ্ঞানচন্দ্রের পুত্র শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ইনি খুবই জনহিতৈষী এবং মানব দরদী ছিলেন, তৎকালীন খুলনা জেলা বোর্ডের সদস্য ছিলেন, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ও ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ঈশ্বরীপুরে পোস্ট অফিস, দাতব্য চিকিৎসালয়, অতিথিশালা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তাঁর ছেলে কালীকানন্দ এবং মাখনলাল চট্টোপাধ্যায় বিগত শতকের ১৯৮০ এর দশক পর্যন্ত সেবায়িতের দায়িত্ব পালন করেন এঁনারাও এলাকায় সুপরিচিত এবং জনপ্রিয় ছিলেন।
বর্তমানে কালীকানন্দের পুত্র জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ও জ্যোতি চট্টোপাধ্যায় যশোরেশ্বরীর সেবাইতের দায়িত্ব পালন করছেন। এঁরা জয়কৃষ্ণের নবম অধস্থন।
পুন:সংস্কার: প্রায় দুইশত বছর পূর্বে মন্দিরটি পুন:সংস্কার করা হয়েছিল। মন্দির সংলগ্ন যে সকল স্থাপনা যথা নহবৎ খানা, অতিথিশালাসহ অন্যান্য ধ্বংস উন্মুখ স্থাপনাগুলি ঐ সময়ে পুন:সংস্কার বা নির্মাণ করা হয়েছিল পরবর্তী সময়ে মন্দিরটি কিছু কিছু সংস্কার হলেও অনেকাংশ জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। এরই মাঝে চুয়াডাঙ্গা নিবাসী শিল্পপতি গিরিধারী লাল নামীয় এক ধর্মপ্রাণ ব্যাক্তি তীর্থ দর্শনে এসে মন্দির দেখে শুনে স্ব উদ্যোগে ২০০১ খ্রিঃ মন্দিরটি কিছু কিছু অংশ মেরামত ও চুনকাম কবেন এবং মন্দিরের পূর্বপার্শ্বে একটি একতলা বিশিষ্ট অতিথিভবন নির্মাণ করে দেন ।
ঐতিহাসিক এই পীঠস্থান খ্যাত মন্দিরে প্রতিবছর
কার্ত্তিকী অমাবস্যার দীপাবলি রাতে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে যশোরেশ্বরী কালী মায়ের মন্দিরে পুজা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের তীর্থাথী, জিজ্ঞাষু, ভ্রমন পিপাষু মানুষের আগমন ঘটে এই প্রসিদ্ধ যশোরেশ্বরী মন্দিরে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তীর্থ দর্শন: বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তিনি ২৭-০৩-২০২১ খ্রি: তারিখে সাতক্ষীরা জেলার এই ঐতিহাসিক যশোরেশ্বরী পীঠ মন্দিরে কালীমাতা দর্শন করেন এবং পুজো দেন। এ উপলক্ষে সরকারের তত্ত্বাবধানে মায়ের মন্দির সুসজ্জিত করা হয়।
যুগে যুগে কত ভক্ত, কত সাধক এই মন্দিরে পুজো দিয়ে আত্মতৃপ্ত হয়েছেন,তার সঠিক খবর নেই। তবে মধ্যযুগে বাঙালি বারোভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্য এই যশোরেশ্বরী মাতার একনিষ্ঠ ভক্ত ও পুজারী ছিলেন, তিনিই মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এর পূর্বে-পরে বিশেষ কোন রাষ্ট্র নায়কের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বিষয়ক তথ্য জানতে পারিনি। ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই ভক্তিপূর্ণ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বাংলাদেশে অবস্থিত যশোরেশ্বরী মাতার যশ ও খ্যাতি ফের উপমহাদেশেসহ বিশ্ব জানতে পারবে। জয় মাতা যশোরেশ্বরী।