ডেস্ক রিপোর্ট : লাদাখ। হিমালয়ের বিশাল উচ্চতায় অবস্থিত শীতল এক জনবিরল এলাকা। সাম্প্রতিক ভারত-চীন উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এই অঞ্চলটি গতকাল বুধবার জেনারেশন-জেড নেতৃত্বাধীন সহিংস বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। বিক্ষুব্ধ তরুণেরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আঞ্চলিক কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
বিক্ষোভের সমন্বয়কারীরা আল–জাজিরাকে জানিয়েছেন, লাদাখের রাজধানী শহরে লেহে আন্দোলনকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ালে অন্তত চারজন নিহত ও বহু মানুষ আহত হয়। ভারত সরকার অঞ্চলটিতে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের পর এই সংঘর্ষ হয়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীরও বহু সদস্য আহত হয়েছেন।
গত ছয় বছর ধরে লাদাখে হাজারো মানুষ স্থানীয় নাগরিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা ও অনশন চালিয়ে আসছিলেন। তাঁদের দাবি—অঞ্চলের জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষা ও পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা। যাতে জনগণ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষমতা পায়। ২০১৯ সাল থেকে লাদাখ সরাসরি কেন্দ্রের অধীনে শাসিত হচ্ছে।
তবে বুধবার দীর্ঘদিনের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে সরে যায় একদল হতাশ তরুণ। আন্দোলনের অন্যতম মুখ শিক্ষাবিদ সোনম ওয়াংচুক এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘এটি তরুণদের বিস্ফোরণ। এক ধরনের জেন-জেড বিপ্লব, যা তাঁদের রাস্তায় নামিয়ে এনেছে।’ তিনি সাম্প্রতিক দক্ষিণ এশিয়ার কিছু আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেন। যার মধ্যে আছে—নেপালের তরুণদের বিদ্রোহ, যে আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির সরকারকে পতন ঘটেছে।
কীসের কারণে সংঘর্ষ?
গতকাল বুধবার সকালে লাদাখ ‘অ্যাপেক্স বডির’ নেতৃত্বে স্থানীয় অধিকারকর্মীরা টানা ১৫ তম দিনের মতো অনশনে ছিলেন। এ সংগঠনটিতে সামাজিক-ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নানা প্রতিষ্ঠান একত্র হয়েছে। এর আগের সন্ধ্যায় ৬২ ও ৭১ বছর বয়সী দুই আন্দোলনকারী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এতে আয়োজকেরা স্থানীয় হরতালের ডাক দেন। একই সঙ্গে মোদি সরকারের দীর্ঘসূত্রতা ও আলোচনায় না বসা তরুণদের ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে।
ওয়াংচুক সেদিন সন্ধ্যায় এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তরুণেরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কোনো ফল দিচ্ছে না। এরপর লেহ-এর শহীদ স্মৃতিসৌধ চত্বর থেকে তরুণদের নেতৃত্বাধীন একটি দল মিছিল নিয়ে বের হয় এবং সরকারি দপ্তর ও বিজেপি কার্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। সেখানে স্লোগান দিতে দিতে তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে চারজন নিহত হয়। একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহত হয়েছেন আরও অনেকে।
লাদাখ অ্যাপেক্স বডির সমন্বয়ক জিগমাত পালজোর আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আজ লাদাখের ইতিহাসের রক্তাক্ত দিন। আমাদের তরুণদের হত্যা করা হয়েছে—যাঁরা সাধারণ মানুষ, শুধু অনশনের দাবিকে সমর্থন জানাতে রাস্তায় নেমেছিলেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে সরকারের ভুয়া প্রতিশ্রুতিতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল সবাই।’ সহিংসতার মধ্যেই অ্যাপেক্স বডি অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় এবং শান্তির আহ্বান জানায়।
অন্যদিকে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতার সঙ্গে সংঘর্ষে নিরাপত্তা বাহিনীর ৩০ জনের বেশি সদস্য আহত হয়েছে। পুলিশ আত্মরক্ষায় গুলি চালাতে বাধ্য হয়, এতে কিছু প্রাণহানি ঘটে।’
সরকার আরও দাবি করেছে, ‘স্পষ্টতই জনতাকে প্ররোচিত করেছেন ওয়াংচুক। তিনি আরব বসন্তের মতো আন্দোলনের উল্লেখ এবং নেপালের জেন-জেড বিক্ষোভের উদাহরণ দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন।’ যদিও ওয়াংচুক বারবার সতর্ক করেছিলেন যে, সরকারের উদাসীনতা তরুণদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সহিংসতায় ঠেলে দিতে পারে, তিনি জোর দিয়ে বলেন, কখনোই সহিংসতার পক্ষে অবস্থান নেননি।
আন্দোলনকারীরা কী চায়
নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার ২০১৯ সালে একতরফাভাবে ভারতের সংবিধান অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীরের যে বিশেষ মর্যাদা ও রাজ্যের স্বীকৃতি ছিল, তা কেড়ে নেয়। রাজ্যটি মূলত তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল—মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর উপত্যকা, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু এবং লাদাখ। লাদাখে মুসলিম ও বৌদ্ধ উভয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ করে।
মোদি সরকার রাজ্যটিকে ভাগ করে দেয় দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। একটি হলো জম্মু–কাশ্মীর, যেখানে বিধানসভা রয়েছে; অন্যটি লাদাখ, যেখানে কোনো বিধানসভা নেই। উভয়ই কেন্দ্রের অধীনে পরিচালিত হয় এবং ভারতের অন্য রাজ্যের মতো পূর্ণ ক্ষমতা ভোগ করে না। তবে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা থাকায় স্থানীয় জনগণ অন্তত প্রতিনিধি নির্বাচন করে দিল্লির কাছে নিজেদের দাবি জানাতে পারে। লাদাখের মানুষদের সে সুযোগও নেই।
কাশ্মীর বিতর্কিত ভূখণ্ড। এটি ভারত, পাকিস্তান ও চীন—তিন পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে বিভক্ত। ভারত পুরো কাশ্মীরকে নিজেদের দাবি করে, পাকিস্তান দাবি করে ভারতের দখলে থাকা অংশ ছাড়া বাকিটুকু। কাশ্মীরের অপর একটি অংশ চীনের নিয়ন্ত্রণে, যারা আবার পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর পশ্চিমে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে, আর লাদাখের পূর্বদিকে ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে চীনের সঙ্গে।
রাজ্য মর্যাদা হারানোর পর থেকে লাদাখিরা মূলত আমলাদের শাসনাধীন হয়ে গেছে। এ অঞ্চলের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ তালিকাভুক্ত অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বা ‘তফসিলি উপজাতি’ হিসেবে চিহ্নিত। সে কারণেই লাদাখকে ভারতের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছে। ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী আদিবাসী ও স্বতন্ত্র সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীর আধিক্য রয়েছে এমন এলাকায় বিশেষ প্রশাসনিক ও শাসন কাঠামো নিশ্চিত করা হয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১০টি অঞ্চল বর্তমানে এই সুবিধার আওতায় আছে।
কিন্তু মোদি সরকার এত দিন ধরে লাদাখের জন্য না রাজ্যের মর্যাদা দিয়েছে, না ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় বিশেষ সুরক্ষা দিয়েছে। জম্মু–কাশ্মীর থেকে আলাদা হওয়ার পর লাদাখিদের চাকরির ক্ষেত্র আরও সংকুচিত হয়েছে। আগে ঐক্যবদ্ধ রাজ্যে বেশির ভাগ চাকরি ছিল জম্মু–কাশ্মীরে। কিন্তু এখন লাদাখিরা সে সুযোগ পাচ্ছে না। ২০১৯ সালের পর থেকে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নীতিও নেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করছে।
পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুক বুধবার বলেন, ‘তরুণ–যুবকেরা পাঁচ বছর ধরে বেকার। লাদাখকে সাংবিধানিক সুরক্ষাও দেওয়া হয়নি। এটাই সমাজে অস্থিরতা তৈরির পথ—তরুণদের বেকার রাখো, তারপর তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারও কেড়ে নাও।’
লাদাখের সাক্ষরতার হার ৯৭ শতাংশ, যা ভারতের জাতীয় গড় ৮০ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু ২০২৩ সালের এক জরিপ বলছে, লাদাখে স্নাতক পাস তরুণদের ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ বেকার। এটি জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ। আর এসবের ফলশ্রুতিতেই বুধবার লাদাখিদের ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়।
লেহ অঞ্চলের শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিদ্দিক ওয়াহিদ বলেন, ‘লাদাখে যা ঘটছে তা ভয়াবহ। লাদাখকে যে দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তা আরও ভয়ের।’ তাঁর মতে, গত ৬ বছরে লাদাখিরা উপলব্ধি করেছে তাদের পরিচয়ের ওপর কী ধরনের হুমকি নেমে এসেছে। ওয়াহিদের ভাষায়, ‘তাদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, সেই অধিকার ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে তারা দৃঢ় অবস্থানে আছে।’
তরুণদের ক্ষোভকেও তিনি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘তারা ধৈর্যহীন হয়ে উঠেছে। এত বছর ধরে সমাধানের অপেক্ষায় ছিল। এখন তারা হতাশ, কারণ নিজেদের জন্য কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না।’
লাদাখে কী এর আগেও বিক্ষোভ হয়েছে
লাদাখে এর আগেও প্রতিবাদ হয়েছে। অঞ্চলের আংশিক স্বায়ত্তশাসন বাতিল ও রাজ্য মর্যাদা তুলে নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন স্থানীয় নাগরিক সংগঠন প্রতিবাদ মিছিল করেছে এবং কখনো কখনো অনশনেও বসেছে। শিক্ষাবিদ ওয়াংচুক গত তিন বছরে পাঁচবার অনশন করেছেন, লাদাখের জন্য সংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবি নিয়ে। তিনি লাদাখের প্রতিবাদ আন্দোলনের সবচেয়ে পরিচিত মুখ, কারণ তার আগে তিনি পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে নানা উদ্ভাবন করেছিলেন, যার কারণে তার পরিচিতি আরও বিস্তৃত। এমনকি ওয়াংচুকের জীবনধারা থেকে বলিউডে একটি ব্লকবাস্টার সিনেমাও তৈরি করা হয়েছে। সিনেমাটির নাম ‘থ্রি ইডিয়টস।’ এই সিনেমা চীনেও বিশাল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
লাদাখিরা যে স্থানে অনশনে বসেছিলেন বা বসেন, সেটির নাম—মার্টায়ারস্ মেমোরিয়াল পার্ক। মূলত তিন লাদাখির স্মরণে এই পার্কের নামকরণ। ১৯৮৯ সালে লাদাখ, জম্মু ও কাশ্মীরের একীভূত রাষ্ট্রে কাশ্মীরি আধিপত্যের অভিযোগে প্রতিবাদের সময় গুলিতে নিহত ৩ ব্যক্তি নিহত হন। তাদের স্মরণেই এই পার্ক।
এই স্থানে আরও দুই প্রতিবাদকারীর স্মৃতিও আছে। তাঁরা ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে লাদাখিদের জন্য শিডিউলড ট্রাইব স্ট্যাটাস চেয়ে আন্দোলনের সময় প্রাণ হারান। কিন্তু বুধবারের প্রতিবাদ লাদাখের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন হিসেবে চিহ্নিত হলো।
মোদি সরকার গঠিত এক কমিটির নাগরিক সদস্য সাজাদ কারগিলি। তাঁর দায়িত্ব যারা আন্দোলন করছে, তাদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলা। তিনিও বলেছেন, লাদাখে এই সহিংসতা ‘যুব সমাজের হতাশা’ তুলে ধরেছে। তিনি বলেন, ‘সরকারকে বুঝতে হবে এখানে এমন তরুণেরা আছেন যারা রেগে আছেন এবং শুধু অনশনে বসে থাকছেন না। মোদি সরকারকে এই আহ্বানগুলো উপেক্ষা করলে চলবে না।’
লাদাখ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
লাদাখ ভারতের হিমালয় সীমান্তে অবস্থিত চীনা সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চল। এ অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ পর্বতমুখী পথ, বিমানঘাঁটি এবং সরবরাহ রুটের সঙ্গে সংযুক্ত, যা ভারতের জন্য চীনের সঙ্গে যেকোনো সংঘাতের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২০ সালে ভারত ও চীনের সেনারা পূর্ব লাদাখে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) বরাবর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
সে সময় সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা এবং চারজন চীনা সেনা নিহত হন। সংঘর্ষের পরে দুই দেশের পক্ষ থেকে প্রচুর সেনা মোতায়েন করা হয়, ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও অবকাঠামো হাই-অল্টিটিউড পোস্টে পাঠানো হয়। তারপর থেকে লাদাখ ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। বহু দফা সামরিক ও কূটনৈতিক আলোচনা চলার পর গত বছরের শেষের দিকে উত্তেজনায় কিছুটা শান্তি এসেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওয়াহিদ বলেছেন, ২০১৯ সালে মোদি সরকারের পদক্ষেপ এখন ভারতকে নতুন হুমকির মুখে ফেলেছে—এইবার লাদাখেই অভ্যন্তরীণ হুমকি তৈরি হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ভারত দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীরকে ‘অসন্তুষ্টির কেন্দ্র’ হিসেবে মোকাবিলা করেছে। এখন তার সঙ্গে লাদাখকেও মোকাবিলা করতে হবে।