
বিশেষ প্রতিনিধি : একসময় চিংড়ি নিয়ে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রণোদনা আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হাজার হাজার হেক্টর ধানক্ষেত রূপান্তরিত হয়েছিল চিংড়ির ঘেরে। রপ্তানি আয় বাড়ার লোভনীয় হাতছানিতে লবণাক্ত পানি সচেতনভাবে প্রবেশ করানো হয় মিঠা পানির অঞ্চলে। স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক চক্রের ছত্রছায়ায় কৃষকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই আগ্রাসন চলে। যে জমিতে একসময় সোনার ধান ফলত তা ধীরে ধীরে বন্ধ্যা হয়ে পড়ে। এর সামাজিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ক্ষমতা আর অর্থের জোরে কৃষকের জমি দখল হয় এবং একটি ভূমিহীন শ্রেণির জন্ম হয়। এই সামাজিক ভাঙনের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় শিকার হয় নারী ও শিশুরা। যে চিংড়িকে ভাবা হয়েছিল আশীর্বাদ, তা-ই উপকূলীয় জনজীবনে পরিণত হয় অভিশাপে। এই পরিবর্তিত বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে নারীদের।
উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির তীব্র অভাব। একটি ওয়াটার ট্যাংক হয়তো একটি গ্রামের পানির চাহিদা মেটাতে পারে, কিন্তু যখন পুরো একটি অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে যায়, তখন প্রয়োজন হয় সমন্বিত এবং বৃহৎ আকারের পরিকল্পনার। এর অভাবে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হয় নারীদের। কারণ, এখানকার প্রায় সব পরিবারের খাবার পানি নারীদেরই সংগ্রহ করা লাগে।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ফাতেমা বেগমের কথাই ধরা যাক। তার দিন শুরু হয় ভোরের আলো ফোটার আগে। পরিবারের সবাই যখন ঘুমে, তাকে ছুটতে হয় নিরাপদ পানির সন্ধানে। প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের একটি পুকুর থেকে তাকে পানি বয়ে আনতে হয়। লবণাক্ততার কারণে গ্রামের বেশিরভাগ নলকূপ আর পুকুর এখন ব্যবহারের অযোগ্য। কাঁখে ভারী কলসি আর পায়ে কাদা মেখে এই পথ পাড়ি দেওয়া তার প্রতিদিনের রুটিন। তার এই যাত্রায় সঙ্গী হয় গ্রামের অন্যান্য বাড়ির নারীরা। পানি এনেই শেষ নয়, এখানকার অনেক নারীকেই ছুটতে হয় নদীতে অথবা চিংড়ির ঘেরে। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নোনা পানিতে চিংড়ির পোনা ধরে সেগুলো ঘেরে ছাড়া বা মাছের খাবার দেওয়ার কাজ করতে হয়। পায়ের আঙুলের ফাঁকে লবণাক্ত পানির কারণে ঘা হয় অনেকেরই। এছাড়া অন্যান্য শারীরিক সমস্যা তো লেগেই থাকে। তীব্র যন্ত্রণা হলেও কাজ থামানোর উপায় নেই। কারণ, তাদের আয়ের ওপর সংসারের অনেকটা নির্ভর করে। দিনশেষে বাড়ি ফিরে আবার রান্নাবান্না আর সংসারের হাজারো কাজ। নিজের শরীরের দিকে তাকানোর ফুরসতটুকুও তার মেলে না। এই গল্প কোনো বিচ্ছিন্ন গ্রামের ঘটনা নয়, এটিই উপকূলের অনেক গ্রামের হাজারো নারীর প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিচ্ছবি।
উপকূলীয় নারীর জীবন এক অনন্ত সংগ্রামের নাম। দিনের বড় একটি সময় লবণাক্ত পানিতে নেমে কাজ করতে হয় বলে তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা মারাত্মক। লবণাক্ত পানির আগ্রাসন শুধু মাটির গভীরে নয়, নারীর শরীরের গভীরেও পৌঁছেছে। চর্মরোগ, খোসপাঁচড়া এবং চুলকানি একটি সাধারণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এর চেয়েও ভয়াবহ হলো জরায়ুর সংক্রমণ। অপরিষ্কার ও লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে বহু নারী মাসিকের সময় জটিলতায় ভোগে এবং জরায়ুর ইনফেকশনসহ দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হয়। সামাজিক লজ্জা এবং দারিদ্র্যের কারণে তারা সহজে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারে না। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অপ্রতুলতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলে একটি নিরাময়যোগ্য রোগও দীর্ঘস্থায়ী ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই শারীরিক সংকট কেবল নারীদের একার নয়, এটি প্রভাব ফেলে পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও। অসুস্থ মায়েদের সন্তানেরা প্রায়শই অপুষ্টি আর নানা জটিলতা নিয়ে জন্মায়।
তবে উপকূলের এই নারীরা শুধু পরিস্থিতির শিকার হয়ে বসে থাকেনি। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কাজের সন্ধানে শহরে পাড়ি জমালে সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে নারীর ওপর, যা তাদের জীবন সংগ্রামকে আরও কঠিন করে তোলে। তারা এই লবণাক্ততাকে সঙ্গী করেই খুঁজে নিয়েছে নতুন পথের দিশা। প্রতিকূলতাকে শক্তিতে রূপান্তর করে তারা হয়ে উঠেছে একেকজন সফল উদ্যোক্তা। যে লবণাক্ততা তাদের ধান চাষ কেড়ে নিয়েছে, সেই নোনা পানিতেই তারা শুরু করেছে কাঁকড়া চাষ। পরিবারের পুরুষ সদস্যের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই নারীরা কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পরিবারের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখাচ্ছে। অনেক নারীই এখন চিংড়ি ঘেরের কাজের পাশাপাশি বাড়ির উঠোনে ছোট খাঁচায় কাঁকড়া চাষ করছে।
এর পাশাপাশি গৃহস্থালির সার্বিক দায়িত্বও তারা সামলায়। বাড়ির উঠোনে হাঁস-মুরগি পালন কিংবা গবাদি পশু চরানো তাদের দৈনন্দিন কাজের অংশ। এসব থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে সন্তানের পড়াশোনার খরচ বা পরিবারের ছোটখাটো চাহিদা মেটানো হয়। অনেকে আবার হস্তশিল্পের মতো সৃজনশীল কাজেও নিজেদের যুক্ত করেছে। নকশিকাঁথা বোনা বা স্থানীয় উপকরণ দিয়ে শোপিস তৈরি করে তারা বাড়তি আয়ের সংস্থান করছে। এই অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা তাদের শুধু আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে না, পরিবারে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও বাড়িয়ে দিচ্ছে। যে নারী আগে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারত না, সে-ই আজ পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রণেতা।
জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক এলাকায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য বড় ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। লবণাক্ততা-সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন ও তা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে সেলাই ও অনেক বিকল্প পেশার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এই উদ্যোগগুলো প্রশংসার যোগ্য হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল। উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। বিচ্ছিন্নভাবে নেওয়া প্রকল্পগুলো অনেক সময়ই সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছায় না অথবা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয় না। নারীদের জন্য নেওয়া প্রশিক্ষণগুলোও অনেক সময় বাজারজাতকরণের অভাবে পুরোপুরি সফল হতে পারে না। ফলে এসব নারীদের টিকে থাকতে হয় মূলত নিজেদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করেই। তাদের এই সংগ্রাম কেবল বেঁচে থাকার জন্য নয়। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করার লড়াই। তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে কীভাবে লবণ-সহনশীল সবজির চাষ করতে হয়। বাড়ির পাশে ছোট্ট এক টুকরো জমিতে তারা পুঁইশাক, লাউ বা ঢেঁড়সের মতো সবজি ফলিয়ে পরিবারের পুষ্টির জোগান দেয়।
উপকূলের এই হার না মানা নারীরা শুধু টিকে থাকার যোদ্ধা নয়, তারা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সম্মুখসারির পথিকৃৎ। তাদের জীবনগাঁথা কেবল বঞ্চনা আর কষ্টের নয়, বরং সাহস আর ঘুরে দাঁড়ানোর এক জীবন্ত দলিল। বড় বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যখন জলবায়ু ন্যায্যতা নিয়ে আলোচনা হয়, তখন উপকূলের এই নারীরা তাদের দৈনন্দিন সংগ্রামের মাধ্যমে সেই ন্যায়ের বাস্তব রূপটি দেখিয়ে দেয়। একেকটি নতুন দিন তাদের জন্য নিয়ে আসে একেকটি নতুন লড়াইয়ের আহ্বান। আর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা প্রমাণ করে, জীবন যতই কঠিন হোক না কেন, সংগ্রামের মাধ্যমে জয়ী হওয়া সম্ভব। তাদের এই অদম্য মানসিকতা আর অভিযোজনের ক্ষমতা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের জন্য এক অশেষ অনুপ্রেরণার উৎস।