1. mesharulislammonir1122@gmail.com : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন
  2. info@www.sangjogprotidin.com : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন :
বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ০১:৪৫ অপরাহ্ন

বৈষম্যের শিকার উপকূলীয় জনপদের নারীদের জন্য ‌আন্দোলন করবে কে?

  • প্রকাশিত: বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৫
  • ১৯ বার পড়া হয়েছে

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সব জায়গায় সব ক্ষেত্রে আমরা বঞ্চিত। সমানতালে কাজ করেও পুরুষদের অর্ধেক মজুরি পাচ্ছি। আবার দুপুর ১টা পর্যন্ত কাজ করার নিয়ম থাকলেও প্রায়ই আধা কিংবা এক ঘণ্টা বেশি কাজ করিয়ে নেন মালিকরা।’ অভিযোগের সুরে কথাগুলো বলে বাড়ির পথ ধরেন মুন্সিগঞ্জ আদিবাসীপাড়ার মন্দিরা রানী মুণ্ডা। দুই সন্তানের জননী এ নারী জানান, নারী হওয়ায় অনেক সময় তাদের কাজেও নিতে চান না মালিকরা।
নারীরা আজও অবহেলিত এবং বৈষম্যের শিকার দাবি করে জেলেখালী গ্রামের লক্ষ্মী রানী জানান, কৃষিজমিতে দিনমজুরের কাজ শেষে বাড়িতে ফিরে রান্না করতে হয়েছে। স্কুল থেকে দুই সন্তান ও কাজ থেকে ফেরা দিনমজুর স্বামীকে দুপুরের খাবার দিয়ে গৃহস্থালির কাজ গোছাতে বিকেল গড়িয়েছে। এরপর দুই কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি এনে গোসল করতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। রাতটুকু বিশ্রামের পর সকাল হতেই আবার কাজের জন্য বেরিয়ে পড়তে হবে। হাড়ভাঙা এমন পরিশ্রমের পরও পরিবারে যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়ার অভিযোগ তার।
পঞ্চম শ্রেণি পাস এ নারী বলেন, ‘যদি লেখাপড়া শিখতি পারতাম, তবে হয়তোবা ছোটখাটো চাকরি করলি স্বামী বা শ্বশুরগো মন রাখতি গে এত খাটতি হতো না।’
শুধু মন্দিরা আর লক্ষ্মী রানী নন, বরং উপকূলীয় এ জনপদের নারীদের প্রায় সবারই দাবি, তারা অনেক বেশি অবহেলা এবং বঞ্চনার শিকার। মজুরি বৈষম্যের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ তাদের। শ্যামনগর উপজেলার কদমতলা গ্রামের আছিয়া বেগম, নমিতা রানীসহ কয়েক নারী শ্রমিক জানান, তারা পুরুষের সমান কাজ করে এক বেলার জন্য ২০০ টাকা পাচ্ছেন। অথচ পুরুষরা ৩০০ টাকা পাচ্ছেন।
নকিপুর বালিকা বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তার কাজে নিয়োজিত আছিয়া ও ফরিদা বিবি জানান, সকাল থেকে একই সময়ে পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে কাজে যোগদান করেও তারা পাচ্ছেন ৪০০ টাকা। বিপরীতে পুরুষ শ্রমিকরা সাড়ে ৫০০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন। পাশাপাশি প্রয়োজন ছাড়া নারী শ্রমিকদের কাজে নিতে চান না ঠিকাদারের লোকজন।
কর্মক্ষেত্র আর মজুরির পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তাসহ পারিবারিকভাবেও এ জনপদের নারী বৈষম্যের শিকার বলে জানান অনেকে। মুন্সিগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী সংযুক্তা, শ্যামলী, রাবেয়া, সুমাইয়াসহ অন্যরা বলেন, মেয়েরা এখনও ন্যায্য অধিকার পাচ্ছেন না। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে পিতামাতা মেয়েদের বেশিদূর পর্যন্ত লেখাপড়া করান না। ছেলেসন্তানদের বিষয়ে তারা উল্টো মনোভাব দেখান। এ ছাড়া স্কুল-কলেজে যাতায়াতের ক্ষেত্রে তারা প্রতিনিয়ত নানা সমস্যার সম্মুখীন হন।
শ্যামনগর উপজেলার কালিঞ্চি, মীরগাং, গাবুরাসহ বিভিন্ন এলাকার নারীদের অভিযোগ, নারী অধিকার  নিয়ে সভা-সমাবেশ হচ্ছে, নারী দিবস পালন হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও অদ্যাবধি নারীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
কয়েক নারী অভিযোগ করেন, বাস কিংবা যানবাহনে চলাচল করতে গিয়ে এখনও পুরুষের টিপ্পনী ও কুদৃষ্টি মোকাবিলা করতে হয়। পারিবারিক ও সাংসারিক বিষয়গুলোতেও নারীদের মতামত উপেক্ষিত হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করে কয়েক নারী জানান, সন্তান জন্মদান আর লালনপালনের বাইরে পরিবারে তাদের কোনো গুরুত্ব নেই। উপযাজক হয়ে পারিবারিক বিষয়ে কথা বলতে গেলে কোনো কোনো সময় সহিংস আচরণের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন কয়েক নারী।
নারীদের অধিকার এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি- দাবি করে শ্যামনগর উপজেলা জাতীয় মহিলা সংস্থার সভাপতি অধ্যাপক শাহানা হামিদ বলেন, পুরুষদের সহযোগিতা ছাড়া নারী অধিকার পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আগের তুলনায় নারীরা কিছু ক্ষেত্রে অধিকার পেলেও সম্পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষের আচরণগত পরিবর্তনের পাশাপাশি সরকার এবং রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া নারীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে কোটা সংস্কারের দাবির প্রেক্ষাপটে আপিল বিভাগের ২১ জুলাইয়ে ঘোষিত রায় জনমনে মিশ্র অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। আপিল বিভাগের এই রায় ২০১৮ সালে জারিকৃত সরকারের পরিপত্র রহিত করে দেওয়া হাইকোর্টের রায় বাতিল করে ৯৩ শতাংশ ‘মেধা’ ও ৭ শতাংশ কোটার বিধান রেখে সরকারকে প্রজ্ঞাপন জারি করার নির্দেশনা দেয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সে অনুযায়ী ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
এটা ইতিমধ্যে সবারই জানা যে, গত ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হয় প্রথমে কোটা বাতিল ও পরে কোটা সংস্কারের দাবিতে, যা ক্রমে সহিংস ও ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে এবং ঢাকাসহ দেশব্যাপী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। আন্দোলনের ছত্রচ্ছায়ায় সন্ত্রাসীরা বিটিভি ভবন, সেতু ভবন, বিআরটিএ কার্যালয়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বেপজা ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, মেট্রো রেলস্টেশনসহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালায়। ডেটা সেন্টারে অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সারা দেশের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে সব ধরনের বৈদেশিক যোগাযোগ ও লেনদেনসহ আমদানি-রপ্তানি ও অনলাইন ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। সর্বোপরি সারা দেশে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সহিংসতায় সড়ক ও রেলযোগাযোগ অচল হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে মানুষের জীবনযাত্রায় অচলাবস্থা তৈরি হয় এবং তাদের মনে ব্যাপক আতঙ্ক জন্ম নেয়। অফিস-আদালত ছাড়াও কলকারখানা, শপিং মল, রাস্তার পাশের হকারদের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি ও কারফিউর মধ্যেই বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আপিল বিভাগ রায় ঘোষণা করেন এবং তারই প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়।
গত কয়েক দিনের পর্যবেক্ষণ এবং গণমাধ্যমের সংবাদ ও বিশ্লেষণ সূত্রে ধারণা করা যায়, মূলত রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যেই সহিংস ও ধ্বংসাত্মক ঘটনাগুলো ঘটানো হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে আমার প্রশ্ন, এই ঘটনায় হতাহত মানুষের ক্ষতিপূরণ কে দেবে? কিংবা জনগণের অর্থে নির্মিত লাখো কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের দায়ই বা নেবে কে?
উল্লেখ্য, মহামান্য আপিল বিভাগ ৭ শতাংশ নিয়োগ কোটার মাধ্যমে সংরক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য (নাতি-নাতনিদের জন্য নয়), ১ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য। আপিল বিভাগের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে যে, ৭ শতাংশ কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বৈষম্যের কারণে নয় বরং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মানবশত এবং বাকি ২ শতাংশ কোটা বৈষম্য দূর করার প্রয়োজনে রাখা হয়েছে। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছি, এই রায়ে নারীদের জন্য কোটা সংরক্ষণের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। দৃশ্যত কোটা সংস্কারপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা যেভাবে চেয়েছে, রায়ে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। এতে মনে হতে পারে যে, বাংলাদেশে নারীদের প্রতি কোনো বৈষম্য বিদ্যমান নেই!
আমরা জানি আদালত, বিশেষ করে উচ্চ আদালত সংবিধানের রক্ষাকর্তা। কিন্তু নারীদের জন্য কোটা না রেখে ঘোষিত আপিল বিভাগের এই রায়ে আমরা নারীসমাজ শুধু দুঃখিতই নই, উপরন্তু এ ঘটনায় আমাদের ক্ষোভের অন্ত নেই। সরকারি-বেসরকারি তথ্য-উপাত্ত সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশের নারীরা এখনো সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার, যারা জনগোষ্ঠীর ৫০ শতাংশ। এখানে উত্তরাধিকারে নারীদের সমান অধিকার নেই। রাস্তাঘাটে ও যানবাহনে তাদের চলাফেরা আজও নিরাপদ নয়। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী ৮০ শতাংশের বেশি নারী পরিবারের মধ্যেই বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। যদিও নারীসমাজের ধারণা এটা খুবই রক্ষণশীল হিসাব, প্রকৃতপক্ষে এই হার ৯০ শতাংশেরও বেশি হবে। কাজেই আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে চাই যে, আদালতের এই রায় সংবিধানকে সমুন্নত রাখে কিনা সে সম্পর্কে নারীসমাজ সন্দিহান, যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের ঘোষণা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিকের সমান অধিকার ও সমমর্যাদার কথা বলা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাকে সামনে রেখে মহামান্য আদালতের কাছে আমি নারীসমাজের পক্ষে দাবি রাখতে চাই যে, নারীর কোটা কমপক্ষে ২৫ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন।
বিভিন্ন কারণে সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অগ্রসর করে নিয়ে আসতে তাদের জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়নের কথা সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কোটা হচ্ছে নারীসহ নাগরিকদের অনগ্রসর অংশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার অন্যতম একটি পদ্ধতি, যা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। জাতিসংঘের বিভিন্ন এজেন্সি নানা দলিলের মাধ্যমে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপের তাগিদ দিয়েছে এবং কোটা ও অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর করে নিয়ে এসে একই সমতলে দাঁড় করাবার দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজিরর সঙ্গেও সম্পর্কিত। এসডিজির অন্যতম মূলনীতি হলো ‘লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড’। এর মানে হলো কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না। সুতরাং রাষ্ট্রের ৫০ শতাংশ নাগরিক নারীকে পেছনে ফেলে রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে সফলভাবে এসডিজির লক্ষ্য অর্জন কিছুতেই সম্ভব নয়।
এটা সত্য যে, বাংলাদেশের নারীরা পাহাড়সম বাধা ডিঙিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন। রাজনীতিতে, প্রশাসনের উচ্চপদে, ব্যবসাবাণিজ্যে অনেক নারীই সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর জন্য সে হার এখনো খুবই নগণ্য। বস্তুতপক্ষে এ দেশের সব নারীই এখনো কম-বেশি বৈষম্যের শিকার। নমুনা হিসেবে কয়েকটি দৃষ্টান্ত হাজির করা যাক :
আমাদের সব নারীকেই আজও প্রতিটি খানায় রাতদিন বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিতে হয়, যে শ্রমের হিসাব জিডিপিতে অদৃশ্য থেকে যায়। নারীর এ ধরনের পুনরুৎপাদনমূলক শ্রমকে গণনায় নেওয়ার বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং বাংলাদেশেও এটা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যেখানে খোদ প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন নারীদের বিনা পারিশ্রমিকের এই শ্রমের মূল্য জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তা ছাড়া, খানা পর্যায়ে বিনা পারিশ্রমিকের গার্হস্থ্য কর্মের অতিরিক্ত ভার সামলাতে হয় বলে নারীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ একেবারেই পান না বা খুব কম পান, যা তাদের বিভিন্ন দিক থেকে পিছিয়ে দেয়।
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বিষয়ে দীর্ঘদিনের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নারীসমাজ একটি দাবি আদায় করতে পেরেছিল যে, প্রত্যেকটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ২০২১ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগসহ কোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন এই লক্ষ্য অর্জনের মেয়াদ উন্মুক্ত করে দেয়। অর্থাৎ লক্ষ্যটি এখনো অর্জিত হয়নি, যা আমাদের অর্জন করতে হবে।
মহান সংবিধান সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার দেওয়ার অঙ্গীকার করলেও বাংলাদেশের নারীরা আজও উত্তরাধিকারে সমান অধিকার পায় না। অথচ উত্তরাধিকারে সমান অধিকার না থাকা নারীর প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিয়ে, অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হতে না পারাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অনগ্রসরতার মূল কারণ। উত্তরাধিকারে নারীকে সমান অধিকার প্রদান করা শুধু নারীর স্বার্থে নয়, বরং গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সাম্য এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের অঙ্গীকারকে রক্ষা করার জন্যই দরকার। উত্তরাধিকার প্রশ্নে যারা ধর্ম ও সংস্কৃতির অজুহাত দেয় তাদের এই অজুহাত অসাংবিধানিক।
মহামান্য আপিল বিভাগ জানিয়েছে যে, কোটা সংরক্ষণের ব্যাপারটি আদালতের বিষয় নয়, বরং সরকারের নীতিগত বিষয়। সরকারের নির্বাহী বিভাগ প্রয়োজন মনে করলে এ ক্ষেত্রে নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এই প্রেক্ষাপটে সুনির্দিষ্টভাবে কোটার মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পুলিশ, প্রশাসক, বিচারক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পর্যায়ে আরও নারী নিয়োগ করার জোর দাবি জানাই, যাতে সব সরকারি অফিসে, পুলিশ স্টেশনে, আদালতে নারীরা অধিষ্ঠিত হতে পারেন। কারণ পুলিশ স্টেশনে ও আদালতে নারী কর্মকর্তা থাকলে বিচারপ্রার্থী নারীরা অবাঞ্ছিত ও অশ্লীল ভাষিক আক্রমণ থেকে রেহাই পায়, নির্যাতিত নারীদের বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এসব ক্ষেত্রে নারীদের সমান সংখ্যক পদে নিয়ে আসা গেলে নারীরা রাষ্ট্রের সমান নাগরিক হিসেবে সব মানুষের সমান মর্যাদা পাবে, যে অঙ্গীকার আমাদের সংবিধান করেছে।
মনে রাখতে হবে যে, গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে এই দেশের অর্থনীতিকে ধরে রেখেছেন শ্রমিক, বিশেষ করে গার্মেন্টস শ্রমিক নারী, গৃহকর্মী নারী এবং ঘরে ঘরে বিনা পারিশ্রমিকের কর্মভার সামলানো নারীরাই। গার্মেন্টসের নারীদের সস্তাশ্রম যে নিয়মিত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দেয়, এ কথা আমরা প্রায়ই মনে রাখি না। নারীরা নতুন প্রজন্মকে জন্ম দিয়ে আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করে থাকে; যার মাধ্যমে তাদের রক্ত, তাদের শক্তি, তাদের ঘাম দিয়ে তারা দেশের জনশক্তি বা শ্রমশক্তি যাই বলা হোক না কেন, এই জাতিকে সরবরাহ করে চলেছে। আমরা যদি একটু অতীতের দিকে তাকাই তো দেখি, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলকে ধরে রাখতে জোহরা তাজউদ্দীন, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আইভি রহমান প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। কিংবা মুক্তিযুদ্ধপূর্বকালে দেশে ও বিদেশে জনমত সৃষ্টিতে অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীর উজ্জ্বল অবদানও স্মর্তব্য। মনে করা যেতে পারে, বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাও। বিরূপ সময়ে অনেক চেষ্টার পরে দেশে ফিরে তিনি শুধু আওয়ামী লীগকেই নয়, একই সঙ্গে বাংলাদেশকেও এগিয়ে নিয়ে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছেন। এমনকি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর রান্নাঘর/ড্রইংরুম থেকে এসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকেই দলের ও দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়েছিল। অর্থাৎ সংকটকালে বিভিন্ন সময়ে নারীর যে ত্যাগ ও অবদান, সাধারণ সময়ে আমরা তা প্রায়ই মনে রাখি না। না হলে নারীসমাজকে বঞ্চিত করে, তাদের প্রতি বৈষম্য জিইয়ে রেখে বৈষম্যমুক্তির চিন্তা করার কথা আমরা ভাবতে পারতাম না।
নারীর জন্য সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার যারা মানতে পারেন না, বিভিন্ন অজুহাতে যারা নারীর সমান অধিকারকে অস্বীকার করেন বা পাশ কাটিয়ে যান; সত্যিকারার্থে তাদের বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আস্থা আছে, আমি তা কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না।

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট