
বিশেষ প্রতিনিধি : সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর। কলকাতা থেকে দূরত্ব মাত্র ৬০ কিলোমিটার। ভৌগোলিক অবস্থান, সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা আর পদ্মা সেতর সংযোগে বন্দরটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য হতে পারতো দেশের অন্যতম রাজস্ব কেন্দ্র। সম্প্রতি ভোমরাকে কাস্টমস হাউজ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, এমনকি গুঁড়াদুধ ছাড়া সব ধরনের পণ্য আমদানির অনুমতিও মিলেছে।
কিন্তু ঘোষণা যতই আকর্ষণীয় হোক, বাস্তব চিত্র তার সম্পূর্ণ উল্টো। অবকাঠামোগত সংকটে থেমে আছে বন্দর উন্নয়ন। ব্যাহত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম।
ভোমরা স্থলবন্দরের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ এপ্রিল। ২০১৩ সালে ওয়্যারহাউজ নির্মাণের পর পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের মর্যাদা পায়। তিন দশক পার হলেও আন্তর্জাতিকমানের শেড, পর্যাপ্ত রাস্তা, ট্রাক টার্মিনাল, স্ক্যানার, ল্যাবরেটরি কোনোটিই এখনো পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি। ফলে বন্দরটি কাগজে যত শক্তিশালী, মাঠে বাস্তবতা ঠিক বিপরীত।
ভোমরা কাস্টমস স্টেশন সূত্রমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভোমরা বন্দর দিয়ে ৫৯ হাজার ৬৯৩টি গাড়িতে ৮ হাজার কোটি ৭৫ লাখ টাকা মূল্যের ২০ লাখ ৮২ হাজার ৭২২ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছে। সরকার রাজস্ব পেয়েছে ৯৭৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরে আমদানি বেশি হলেও রাজস্ব ছিল ৯০৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, অর্থাৎ রাজস্ব বৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। একই সময়ে রপ্তানিতেও বেড়েছে প্রবৃদ্ধি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২২ হাজার ৯৩৭টি গাড়িতে ৩ হাজার ৪০৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকার ২ লাখ ৮৬ হাজার ১৩০ টন পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। সব মিলিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আয় গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ৯২ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
কিন্তু রাজস্ব প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, লক্ষ্যমাত্রা আরও অনেক বেশি হতে পারত। পর্যাপ্ত শেড না থাকায় কৃষিপণ্য ও খাদ্যদ্রব্য খোলা আকাশের নিচে রাখতে হয়, ফলে নষ্ট হয় পণ্য, ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট শাহানুর ইসলাম শাহিন বলেন, কাস্টমস হাউজ প্রতিষ্ঠা হলেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকলে লাভ নেই। এখনো কোনো শেড নেই, কিপিং লাইসেন্স নেই। জায়গা না পেয়ে ট্রাক দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকে। এতে আমদানিকারকের যেমন ক্ষতি, তেমনি রাজস্বও কমে যায়। রাস্তা ও ট্রাক টার্মিনালের সংকটও ভয়াবহ। বন্দরে ঢোকার রাস্তা সরু, ভাঙাচোরা ও যানজটপ্রবণ। আলাদা ট্রাক টার্মিনাল না থাকায় বন্দরের ভেতরেই বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবু মুসা বলেন, ভৌগোলিকভাবে ভোমরা বন্দর খুব গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকায় পণ্য পরিবহন অনেক দ্রুত হয়। কিন্তু অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা থাকলে ব্যবসায়ীরা বিকল্প হিসেবে বেনাপোল বা সোনামসজিদ বন্দর বেছে নেবেই।
তিনি বলেন, আরও বড় সমস্যা, প্রশাসনিক কাঠামো পূর্ণ না হওয়া। কাস্টমস হাউজ ঘোষণা দেওয়া হলেও কমিশনার ও সহকারী কমিশনার পদে পোস্টিং হয়নি। ফলে অনুমোদনের জন্য ব্যবসায়ীদের খুলনা কাস্টমস অফিসে যেতে হয়। এতে সময় নষ্ট হয়, বিশেষ করে পচনশীল পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্দরে এখনো আধুনিক স্ক্যানার, নিরাপত্তা প্রাচীর, পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ল্যাব নেই। ফলে নিরাপত্তা ও চোরাচালান ঝুঁকিও কাটছে না।
বন্দরের একজন কর্মকর্তা বলেন, হাতেগোনা কিছু সরঞ্জাম নিয়ে কাজ করছি। আন্তর্জাতিকমানের বন্দর পরিচালনা করতে হলে পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামো ছাড়া কোনো উপায় নেই। অবকাঠামোগত সংকট শুধু রাজস্ব ক্ষতিই নয়, প্রায় ৫০ হাজার মানুষের জীবিকায় প্রভাব ফেলছে। ট্রাকচালক, শ্রমিক, হেলপার, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, ছোট ব্যবসায়ী সবাই আয় কমে যাওয়ায় সংকটে পড়েছেন।
সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি নাসিম ফারুক খান মিঠু বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যবসার জন্য যেভাবে ক্ষতিকর, অবকাঠামোগত সংকটও একইভাবে বাণিজ্যকে থামিয়ে দেয়। দ্রুত উন্নয়ন না হলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ভোমরা পিছিয়ে পড়বে।
নাছিম ফারুক খান মিঠু আরও বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে ভোমরা এখন রাজধানীতে পণ্য পরিবহনের দ্রুততম পথ। শুধু উন্নয়ন শেষ হলেই এই বন্দর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক করিডোরে পরিণত হবে।
এদিকে ভোমরা বন্দরের উন্নয়ন নিয়ে সরকারি পরিকল্পনা অনেক বড় বলে জানিয়েছেন স্থলবন্দরের উপপরিচালক মো. আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রথম ধাপে ১০ একর জমি অধিগ্রহণ এবং বালি ভরাটের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। দ্বিতীয় ধাপে ৪৪ একর জমি অধিগ্রহণের কাজও প্রায় শেষ। জমি হস্তান্তর হলেই আধুনিক শেড, ওয়্যারহাউজ, কার্গো ইয়ার্ড, পার্কিং ইয়ার্ড ও আন্তর্জাতিকমানের টার্মিনাল নির্মাণ শুরু হবে।
স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের উন্নয়ন বিভাগের সদস্য (যুগ্মসচিব) মো. শামছুল আলম জানান, প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার ‘ভোমরা স্থলবন্দর সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। ৬৭ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হলেই অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরু হবে। প্রকল্প শেষ হলে ভোমরা হবে দেশের অন্যতম আধুনিক স্থলবন্দর।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক ও জিওবির যৌথ অর্থায়নে চলমান অ্যাকসেস প্রোগ্রামের আওতায় কার্গো হ্যান্ডলিং, ডিজিটাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, উন্নত স্ক্যানার, সংযোগ সড়ক, ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ডসহ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় কাজ চলছে। প্রকল্প পরিচালক মো. রুহুল আমিন মিয়া বলেন, এসব অবকাঠামো সম্পন্ন হলে আঞ্চলিক বাণিজ্যে ভোমরার গুরুত্ব আরও বাড়বে।