1. mesharulislammonir1122@gmail.com : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন
  2. info@www.sangjogprotidin.com : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন :
মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:১৯ অপরাহ্ন

উপকূলীয় অঞ্চলে খাবার পানির সংকট কবে দূর হবে?

  • প্রকাশিত: সোমবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৫
  • ৬২ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি : দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলের অন্তত চার কোটি মানুষ ভয়াবহ খাবার পানির সংকটে ভুগছে। এটা তাদের জীবনযাত্রার সবচেয়ে কঠিন সংকট। চারদিকে অফুরান পানি থাকলেও তা পানযোগ্য নয়। লবণাক্ততার বিস্তার মারাত্মক রূপ নিয়েছে। সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানির আধার কমে গেছে। কুয়া, পুকুর, দীঘি, জলাশয়, খাল-বিল ইত্যাদি লবণাক্ততার গ্রাসে পরিণত হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এমন কি লবণাক্ততা মাটির বিভিন্ন স্তরে প্রবেশ করেছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানিও আর লবণাক্ততামুক্ত নয়। দেশের দক্ষিণ-পূর্বের টেকনাফ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের সাতক্ষীরা-খুলনা পর্যন্ত ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলভাগের ১৯টি জেলা কমবেশি আগ্রাসী লাবণাক্ততার শিকার। লবণাক্ততার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষি। ধান উৎপাদন মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়েছে। মাটিতে অতিরিক্ত লবণের কারণে ধানের গাছ বাড়ে না, শুকিয়ে যায়, শীষে দানা আসে না। ফলে ফলন আশানুরূপ হয় না। অনেক সময় ধানী জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখতে বাধ্য হয় কৃষক। এক পরিসংখ্যান মোতাবেক উপকূলীয় এলাকায় অন্তত ১০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়েছে। কৃষির এই বিপুল ক্ষতি পূরণের কোনো উপায় নেই। কৃষির সঙ্গে মিঠা পানির ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। কৃষির জন্য মিঠা পানির পর্যাপ্ত যোগান অপরিহার্য। খাদ্যশস্য বা অন্য কোনো কৃষিপণ্য বাইরে থেকে আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু খাবার পানির মতো নিত্য প্রয়োজনীয় ও ব্যবহার্য উপকরণের চাহিদা সেভাবে পূরণ করা সহজসাধ্য নয়। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য খাবার পানি সংগ্রহ করা এখন অন্য যে কোনো কাজের চেয়ে বড় কাজ। সাধারণত মহিলা ও শিশুরা খাবার পানি সংগ্রহ করে থাকে। কলসী ও পাত্র নিয়ে তাদের মাইলের পর মাইল গিয়ে কোনো কুয়া, পুকুর বা অন্য কোনো উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। পানির এই অভাব বা সংকটকে পুঁজি করে বিভিন্ন এনজিও পানির ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। গভীর নলকূপ বসিয়ে তারা পাইপে পানি সরবরাহ করে। নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিয়ে এই পানি কিনে নিতে হয়। কোথাও কোথাও এলাকার লোকজন একসঙ্গে মিলে গভীর নলকূপ বসায়। এজন্য এনজিওরা ঋণ দেয়। পর্যায়ক্রমে সুদাসলসহ এই টাকা পরিশোধ করতে হয়। এই ঋণ গ্রহীতাদের অধিকাংশই নারী। তারা অভিনব পানির ঋণে বন্দী হয়ে অসহায় অবস্থার শিকার হচ্ছে। ইনকিলাবের এক খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, কাগজে-কলমে ‘পানির ঋণ’ লেখা থাকে না। অন্য কোনো কারণ দেখিয়ে যে ঋণ দেয়া হয় সেই ঋণের টাকার বিনিময়ে প্রতিদিনই পানি কিনতে বাধ্য হচ্ছে নারীরা। আবার নলকূপ বা গভীর নলকূপ বিকল বা অচল হয়ে পড়লে আবার ঋণ নিয়ে তা মেরামত করতে হয়। এভাবে এনজিও’র ক্ষুদ্র ঋণের নামে মহাজনী চক্রবৃদ্ধি সুদে সর্বসান্ত¦ হচ্ছে লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ। এনজিও’র এরকম নির্বিচার শোষণে মানুষ অতিষ্ঠ ও ক্ষুব্ধ।
উপকূলীয় অঞ্চলে মিঠা পানির সংকট নতুন নয়। বিভিন্ন কারণে বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনে এ সংকট বাড়তে বাড়তে এখন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এক সময় চিংড়ী চাষের জন্য মিঠা পানির ধানী জমিতে সাগরের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়ীর পোনা ছাড়া হতো। এভাবে চিংড়ীর চাষ হলেও ধান চাষের জন্য ওইসব জমি বন্ধা হয়ে যায়। এরূপ বহু জমি ধান চাষের অনুপযোগী হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঘূর্ণিঝড় ও জালোচ্ছ্বাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। সিডর, আইলা, ফনী, আস্ফান ইত্যাদি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বিপুল সংখ্যক উপকূলবাসী হতাহতই হয়নি, তাদের ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত, বৃক্ষ-বাগান, ধ্বংস হয়েছে। আরো একটা বড় ক্ষতি হয়েছে এই যে, উপকূলভাগে লবণাক্ততার বিস্তার ঘটেছে এবং অনেক স্থানে স্থায়ী রূপ নিয়েছে। সুপেয় পানির সংকট, লবণাক্ততা সম্প্রসারণের সংকট, আবাদ-উৎপাদনের সংকট, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সংকটসহ উপকূলীয় জনপদ সুরক্ষার, সংকট মোকাবিলার উপযুক্ত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য বলে গণ্য হলেও গত ৫৪ বছরে কোনো সরকারই কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। উপকূলজুড়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও বনায়ন, সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার তাকিদ যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। যে সব বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়েছে, তা উঁচু ও টেকসই হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার-মেরামত উপেক্ষিত হয়েছে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে প্রতি বছরই বড় অংকের বরাদ্দ দেয়া হলেও তা তেমন কাজে আসে না। অনুরূপভাবে উপকূলীয় বনায়ন ও সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার জন্যও বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে, যা কমই কাজে আসে। অরক্ষিত উপকূল অরক্ষিতই রয়ে গেছে, যা আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি ও দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশের মানুষের বিপুল প্রত্যাশা ছিল। যেহেতু পতিত স্বৈরাচারের সাড়ে ১৫ বছরে দুঃশাসন, খুন, জুলুম, লুটপাট, পাচার ইত্যাদিই ছিল মূল লক্ষ্য, সুতরাং গণপ্রত্যাশা অপূর্ণই থেকে গেছে। উপকূল সুরক্ষা ও উপকূলব্যবস্থাপনার কিছুই ওই সরকার করেনি। উপকূলীয় অঞ্চলে খাবার পানির সংকট প্রকট আকার নিলেও তা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। চীন-শ্রীলংকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সাগরের পানি শোধন করে খাবারের পানিতে পরিণত করার ক্ষেত্রে সাফল্য দেখালেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার পূর্বের সরকারগুলোর মতোই আচরণ করছে। এ সরকার ‘এনজিও সরকার’ বলে অভিহিত হয়ে থাকে। এ কারণে এনজিওদের প্রভাব পতিপত্তি বেড়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলসহ সারাদেশেই তার প্রমাণের অভাব নেই। সাদা পাথর আর প্রবাল রক্ষায় সরকারের অতিরেক দায়িত্বশীলতা লক্ষ করা গেছে। অথচ উপকূল রক্ষা, যানজট নিরসন, আইন শৃংখলার উন্নয়ন, রাস্তাঘাটের সংস্কার, নাগরিক নিরাপত্তা প্রদান, চাঁদাবাজি প্রতিরোধ প্রভৃতি অতি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তার যথেষ্ট নজর আছে, এমন প্রমাণ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানতম যে কাজ অর্থাৎ অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হাস্তানন্তরÑ সে ক্ষেত্রেও তার লেজেগোবর অবস্থা দৃশ্যমান। রাষ্ট্র সংস্কার ও জুলাই সনদ নিয়ে সরকার এ যাবৎ যা করেছে তা সম্পূর্ণ বিফলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সংস্কারের পরিধি কতদূর হবে, জুলাই সনদের অবস্থান কোথায় হবে, তার বাস্তবায়নই বা কীভাবে হবে, সংবিধানে নেই, আরপিওতে নেই, এমন দাবি অর্থাৎ পিআর দাবিরই বা কী হবে এসব বিষয়ে, সরকারের কোনো বক্তব্য নেই। এটা তার দুর্বলতার লক্ষণ। কাজেই, তার উচিত সংস্কার ও জুলাই সনদ নিয়ে কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া এবং নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন সম্পন্ন করা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, দেশের গুরুতর সমস্যাসহ প্রতিদিনের সমস্যা নিয়ে সরকারের যেমন মাথাব্যথা নেই, তেমনি বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাঙিক্ষত দায়িত্বশীলতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এটা কাম্য নয়। আগামীর ক্ষমতাকামী দলগুলোর উচিত জনগণের সংকট-সমস্যা, আশা-প্রত্যাশার সঙ্গে সব সময় সম্পর্কিত থাকা। সমাধান ও বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা ফাতেমা পান করার পানি সংগ্রহ করেন পুকুর থেকে। পুকুরের পানি কতটা নিরাপদ তার জানা নেই, তবে চাহিদা মেটাতে আর বিকল্প নেই। ভোরে অনেকেই কলসি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পানির খোঁজে। কারণ সেটাই পান করবে সবাই, সেটাই ব্যবহার হবে রান্নায়। দীর্ঘদিন ধরেই এ অঞ্চলের মানুষ এ পানি ব্যবহার করে আসছেন।
সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট দীর্ঘদিনের। ভৌগোলিক  কারণে বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছে থাকায় জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায় পানির সংকট অন্য উপজেলার চেয়ে বেশি। এসব এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বড় এসব এলাকার জনগোষ্ঠীকে খাবার পানির জোগানে একেক ঋতুতে একেক উৎসের ওপর নির্ভর করতে হয়।
বৃষ্টির সময় রিজার্ভ ট্যাংকে পানি ধরে রাখা যায়। যা দিয়ে তিন-চার মাসও চলে যায়। বাকি সময় কখনও পুকুর ফিল্টার (পিএসএফ) বা সরাসরি পুকুরের পানি অথবা ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপিত লবণ বিমুক্তকরণ প্ল্যান্ট থেকে এখানকার মানুষের খাবার পানি পায়।
গরমের সময় প্রাকৃতিক উৎস বেশিরভাগই অচল থাকে। ফলে মানুষকে এই সময় পানি কিনে খেতে হয়। এই পানির দাম প্রতি লিটার এক টাকা।
২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে প্রচুর ক্ষতি হয় এই জেলার মানুষের। তারপর থেকেই পানির ভয়াবহ সংকট শুরু। এসময় সাতক্ষীরা পৌরসভা, শ্যামনগর ও আশাশুনিতে কয়েকটি এনজিও এগিয়ে আসে নিরাপদ পানি সরবরাহে। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রয়োজনের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত, নদীর নাব্যতা হ্রাস ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া প্রভাব পড়ছে টিউবওয়েলের ওপরও। টিউবওয়েল থেকেও মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় কম পানি পাচ্ছে। আর লবণাক্ততার কারণে এ সব উৎসের পানি ব্যবহারও দুরূহ হয়ে উঠেছে।
সংকট দূর করতে ২০১৫ সাল থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে চাহিদা মেটানোর কাজ করছে ওয়াটারএইড। তাদের সহযোগিতায় সেটা বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় এনজিও রূপান্তর। এখন পর্যন্ত এসব এলাকার ৪১টি স্কুলে এবং ১৭টি কমিউনিটি ক্লিনিকে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৃষ্টির পানি ফিল্টার হয়ে চেম্বারে যাচ্ছে আর সেটি পান করছে স্কুলের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ।
মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ত্রিপানি বিদ্যাপিঠের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন পানি খাচ্ছিল স্কুলের পেছনের দিঘি থেকে। তাতে নানারকম শারীরিক সমস্যার পাশপাশি স্কুলে আসার প্রবণতাও কমে যেত। ২০১৮ সালে এই স্কুলে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষার্থীরা জানালো, তারা দিঘি থেকে সরাসরি পানি খেতো। পরে পানির স্থাপনা হওয়ার পর তারা এখান থেকেই পানি খায়।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো আবুল কালাম মল্লিক জানান, আগে অধিকাংশ শিশুই পানি নিয়ে আসতো বাড়ি থেকে। অনেক সময় দেখা গেছে পানির অভাবে হয়তো তারা ছুটি চাইতো। দুই-একদিন স্কুলেও আসতো না। এলাকায় এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করায় কিছুটা সুবিধা হয়েছে। পানির কারণে আর শিক্ষার্থী ঝরছে না।
এই স্কুলে যে পানির চেম্বার করা করা হয়েছে সেটার ধারণক্ষমতা ২০ হাজার লিটার। রূপান্তরের কর্মকর্তারা জানান, এই সিস্টেমে একটি ডিসপেনসার পয়েন্ট আছে। এখান থেকে শিশুরা পানি নেয়। বৃষ্টি যখন হয় তখন পানিটা প্রথমে একটি লাইনে এসে পড়বে। পাইপের একটি পয়েন্টে ফিল্টার স্থাপন করা হয়েছে। এই ফিল্টার হওয়ার পর পানিটা ট্যাংকে চলে যাবে। তাছাড়া পাইপের সঙ্গে যুক্ত আছে ফাস্ট ফ্লাশিং সিস্টেম। বৃষ্টি যখন হয় তখন প্রথম বৃষ্টির পানিতে ময়লা থাকে। প্রথম ২৫-৩০ মিনিট এই ফাস্ট ফ্ল্যাশের মাধ্যমে ফেলে দিতে হয়। এই সময় পর সেটি বন্ধ করে দিলে পানি সরাসরি চেম্বারে চলে যাবে।
তিনি আরও জানান, আমরা হিসাব করি যে স্কুলে শিশুর সংখ্যা কত এবং তাদের জন্য ৯ মাসে কী পরিমাণ পানির প্রয়োজন। তার ওপর নির্ভর করে আমরা ধারণক্ষমতা নির্ধারণ করি।
খাবার পানির মান সম্পর্কে ওয়াটার এইডের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার রিভেন চাকমা জানান, আমরা একটা মেকানিজমের মাধ্যমে পানিকে ফিল্টার করছি। ফিল্টার হওয়ার পর সেটি কতটুকু নিরাপদ সেটা নিশ্চিত করতে আমরা কয়েকটি প্যারামিটার পরীক্ষা করি। এগুলো হচ্ছে—ফিকাল কলিফরম, পিএইচ মাত্রা। ল্যাবরেটরি টেস্টের পর শতভাগ নিরাপদ হলে আমরা ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেই। ৯ মাস এই পানি যেহেতু থাকে আমরা ছয় মাস পর পর একটা মনিটরিং টেস্ট করি। আমাদের এক একটি প্রকল্পের মেয়াদ ১০ বছর।
ওয়াটারএইডের অ্যাডভোকেসি এবং কমিউনিকেশন ম্যানেজার ফয়সাল আব্বাস জানান, সাতক্ষীরার এসব অঞ্চলের মানুষ অনেক কষ্ট করে পানি সংগ্রহ করে। আমাদের যেসব প্রকল্প এখানে বাস্তবায়িত হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে কাজ করছে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা। আমরা জানি যে এসব এলাকার মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানাকারনে যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করে। আমাদের প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে নিরাপদে কীভাবে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করা যায় তার একটি উদাহরণ। এখানে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ফিল্টারিং সিস্টেম এবং লবণাক্ততার কারণে অবকাঠামোগুলো টেকসই না হওয়া। আমরা যদি কমিউনিটিকে নিয়ে অবকাঠামোগত জায়গায় কাজ করতে পারি তাহলে সেটি আরও দীর্ঘমেয়াদি হবে। পানি এবং স্বাস্থ্যগত বিষয়ে যদি মানুষ জানতে পারে তাহলে জীবনযাপন আরও সুন্দর করে করতে পারবে।
সাতক্ষীরা জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে ‌জানান, সাতক্ষীরা জেলায় পানির লবণাক্ততা অনেক বড় একটা সমস্যা। এই জেলায় অনেক মূল্যবান রিসোর্স আছে। প্রতিবছর ঝড় সাইক্লোনের সরাসরি ঝুঁকিপূর্ণ শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলা। দুর্যোগের প্রভাব সরাসরি এসব এলাকার মানুষের ওপর পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক বড় প্রভাব পড়েছে এই জেলায়। সরকার দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে কাজ করছে। আমি মনে করি সাতক্ষীরা জেলায় একটি মাস্টার প্ল্যান দরকার। এখানে লবণাক্ততা দূর করার জন্য বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে ব্যবস্থাপনায় আমাদের সব দফতর সংস্থা মিলে একটি সমন্বিত মাস্টার প্ল্যান করার প্রয়োজন আছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা উপকূলীয় এলাকাসমূহে সুপেয় পানির সংকট অত্যন্ত তীব্র। চারপাশে বিস্তীর্ণ জলরাশি থাকলেও কোনো পানিই পানযোগ্য নয়। এমনকি এই পানি গৃহস্থালির কাজেও ব্যবহার করা প্রায় অসম্ভব। পানির সন্ধানে এখানকার মানুষ দূরদূরান্তে ছুটে বেড়ায়। চড়া দাম দিয়েও অনেক সময় পানযোগ্য পানি পাওয়া যায় না। নারীরা কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে পায়ে হেঁটে পানি সংগ্রহ করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্রের নোনা জল খুব সহজে মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ও তীব্রতা, যার ফলে উপকূলীয় বাঁধ ভেঙে কিংবা উপচে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয়। অন্যদিকে, উজানের নদীগুলোতে স্বাদু পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়া এবং নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে সমুদ্রের জল দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে। এই প্রাকৃতিক কারণগুলোর পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণ হিসেবে আশির দশকে ‘ব্লু গোল্ড’ বা ‘সোনালি সম্ভাবনা’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া চিংড়ি চাষ এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। অধিক মুনাফার লোভে হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে পরিকল্পিতভাবে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়ি ঘের তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে আর্থিক সচ্ছলতা আনলেও দীর্ঘমেয়াদে মাটির উর্বরতা চিরতরে নষ্ট করে দিচ্ছে, স্বাদু পানির ভূগর্ভস্থ স্তর দূষিত করছে এবং মিঠা পানির প্রাকৃতিক আধারগুলো ধ্বংস করছে।
এই সংকট কেবল পানীয় জলের অভাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক বিপর্যয়ও সৃষ্টি করেছে। লবণাক্ত পানি ব্যবহারে চর্মরোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানির জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে নারীরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন এবং মেয়েরা শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ছে।
এই সংকট মোকাবিলায় গত কয়েক দশক ধরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন থেকেই যায়। ষাটের দশকে উপকূলীয় জনগণকে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করতে পোল্ডার বা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ‘কোস্টাল এমব্যাঙ্কমেন্ট ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (ঈঊওচ)’-এর মতো বড় প্রকল্পের মাধ্যমে সেই বাঁধগুলোকে আরও উঁচু ও শক্তিশালী করা হয়েছে। নব্বইয়ের দশক থেকে ব্র্যাকের মতো বেসরকারি সংস্থা এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (উচঐঊ)-এর উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের (জধরহধিঃবৎ ঐধৎাবংঃরহম) জন্য ট্যাংক স্থাপন শুরু হয়, যা একটি জনপ্রিয় কমিউনিটি-ভিত্তিক সমাধান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এর পাশাপাশি, মিষ্টি পানির আধার হিসেবে পুকুর পুনঃখনন এবং পানি পানের উপযোগী করতে পুকুর-বালি ফিল্টার (চঝঋ) স্থাপনের মতো স্থানীয় প্রযুক্তিও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। একবিংশ শতাব্দীতে, বিশেষ করে গত দশকে, বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে সৌরশক্তি চালিত রিভার্স অসমোসিস (জঙ) প্ল্যান্ট স্থাপন করে লবণাক্ত পানিকে সুপেয় পানিতে রূপান্তরের আধুনিক প্রযুক্তিও আনা হয়েছে। কিন্তু এই প্রশংসনীয় উদ্যোগগুলো বিচ্ছিন্ন এবং খণ্ডিত হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদী সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিটি সমাধানই সমস্যার কোনো একটি দিক নিয়ে কাজ করে, কিন্তু সামগ্রিক চিত্রকে বদলে দিতে পারে না। কমিউনিটি-ভিত্তিক বৃষ্টির পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা কেবল বর্ষা মৌসুমের কয়েক মাসের জন্য কার্যকর থাকে। শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি-মে), যখন পানির চাহিদা ও লবণাক্ততা দুটোই সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে, তখন সংরক্ষিত পানি ফুরিয়ে যাওয়ায় এই ব্যবস্থা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, পুকুর বা চঝঋ ব্যবস্থাগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস মুহূর্তেই মিষ্টি পানির একমাত্র আধারটিকে লবণাক্ত করে তুলতে পারে। সবচেয়ে আধুনিক সমাধান হিসেবে পরিচিত জঙ প্ল্যান্ট প্রযুক্তিগতভাবে কার্যকর হলেও এর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সীমাবদ্ধতা প্রকট। এর স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিশেষ করে ফিল্টার মেমব্রেন পরিবর্তনের খরচ এতটাই বেশি যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এই পানি সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর চেয়েও বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, এই প্ল্যান্ট থেকে নির্গত বর্জ্য বা ঘন লবণাক্ত পানি (নৎরহব) সঠিকভাবে নিষ্কাশন না করায় তা স্থানীয় পরিবেশে মিশে দূষণ আরও বাড়িয়ে তুলছে এবং মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি করছে। একইভাবে, উপকূলীয় বাঁধগুলো বন্যা থেকে সুরক্ষা দিলেও পোল্ডারের ভেতরে আটকে পড়া লবণাক্ততা দূর করতে বা স্বাদু পানির জোগান দিতে পারে না, ফলে মানুষ ‘রক্ষিত কিন্তু অবরুদ্ধ’ অবস্থায় জীবনযাপন করে। মূল সমস্যাটি হলো আমাদের প্রকল্পভিত্তিক ও বিচ্ছিন্ন মানসিকতা। আমরা সংকটকে একটি সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের অংশ হিসেবে না দেখে আলাদা আলাদা সমস্যা হিসেবে বিচার করছি। এর পেছনের মৌলিক দুর্বলতাগুলো হলো : প্রথমত, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের তীব্র অভাব। প্রত্যেকে নিজেদের মতো করে কাজ করায় কোনো উদ্যোগই পূর্ণাঙ্গতা পায় না। দ্বিতীয়ত, প্রকৃতির নিজস্ব সমাধানকে উপেক্ষা করে ব্যয়বহুল প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানের দিকে ঝোঁকা। ম্যানগ্রোভ বন তৈরি, জলাভূমি সংরক্ষণ এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার মতো প্রাকৃতিক উপায়গুলো আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, স্থানীয় জ্ঞান ও অংশগ্রহণকে উপেক্ষা করা। যে নারীরা প্রতিদিন পানির জন্য সংগ্রাম করছেন, তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে নীতিমালা প্রণয়নের সময় গুরুত্বই দেওয়া হয় না, ফলে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সমাধান ব্যর্থ হয়। সবশেষে, স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার আধিক্য। বেশিরভাগ উদ্যোগই প্রকল্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কার্যকারিতাও হারিয়ে ফেলে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কোনো একক জাদুকরী সমাধান নেই। এর জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত, প্রকৃতি-ভিত্তিক এবং জনগণকেন্দ্রিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
আশার কথা হলো, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত শতবর্ষী ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ এই পথের একটি যুগান্তকারী রূপরেখা, যার অধীনে উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনার আওতায় নদী খনন, স্বাদু পানির প্রবাহ বৃদ্ধি এবং কৌশলগতভাবে পোল্ডার ব্যবস্থাপনার মতো উদ্যোগগুলো দ্রুত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি।

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট