1. mesharulislammonir1122@gmail.com : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন
  2. info@www.sangjogprotidin.com : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন :
মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:১৭ অপরাহ্ন

সর্বক্ষেত্রে ‌ন্যায্য মজুরি পান না উপকূলের নারী শ্রমিকরা

  • প্রকাশিত: সোমবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৫
  • ৬৪ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি : দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি নারীরা এগিয়ে গেলেও সাতক্ষীরার উপকূলের নারীরা আজও অবহেলিত। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর নারী শ্রমিকরা তাদের অধিকার ও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
জানা গেছে, সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরা কাঁকড়ার খামার, মাছের ঘের, নদীতে রেণু আহরণ, সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরা, রাজমিস্ত্রির সহকারী, মাটিকাটা, গ্রামীণ রাস্তানির্মাণ ও সংস্কার, কৃষিকাজ করেন। তবে এসব নারী শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
সাতক্ষীরা শ্যামনগরের কর্মজীবন নারী সেলিনা বেগম বলেন, ‘আমি একটি কাঁকড়ার খামারে কাজ করি। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। মাসিক বেতন সাড়ে ৭ হাজার টাকা। আমার সঙ্গে একই কাজ করে একজন পুরুষ সহকর্মী বেতন পান ৯ হাজার টাকা। খামারের অনেক কঠিন কাজ আমি করি। বাকিরা আমার চেয়ে সহজ কাজ করে কিন্তু পুরুষ হওয়ায় তাদের বেতন বেশি। বার বার বেতন বাড়াতে বললেও কাজ হয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি আগে ৮ ঘণ্টা কাজের সময়ের বিষয়ে জানতাম না। কাঁকড়ার খামারে দায়িত্বশীল লোকজন আমাদের বলেছে বাইরে থেকে কেউ আসলে বলতে ৮ ঘণ্টা ডিউটি বাকি চার ঘণ্টা ওভারটাইম। বাস্তবে তারা ৪ ঘণ্টা ওভারটাইম দেয় না। ১২ ঘণ্টার বেশি কাজ করলে তখন ওভারটাইম দেয়। নারী দিবস শুধু আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ আমাদের ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন হয় না।’
সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার দাতিনাখালি বনজীবী নারী উন্নয়ন সংগঠনের পরিচালক শেফালী বেগম। তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলে অধিকাংশ পুরুষ সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। আগে বছরে তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা থাকতো কিন্তু বর্তমানে ছয় মাস থাকে। সে কারণে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের কাজ করতে হয়। না হলে তাদের সংসার চলে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই অঞ্চলে অধিকাংশ নারীরা কাঁকড়া খামারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। কিছু নারী মাছের ঘেরে, নদীতে রেণু আহরণ, সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরা, রাস্তা সংস্কার ও কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। তাদের বাড়ির কাজ করতে হয় পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে সমান বা তার চেয়ে বেশি কাজ করতে হয়। এরপরও পুরুষ যে মজুরি পায়, নারী পায় তার অর্ধেক। রাস্তা সংস্কারের কাজে একজন পুরুষ ৫০০ টাকা পেলে নারীকে দেওয়া হয় ৩০০ টাকা।
‘এই এলাকার অধিকাংশ নারী তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা বিষয়ে অধিকাংশই জানেন না। অনেকে জানলেও কাজ হারানোর ভয়ে এ বিষয়ে মুখ খুলতে চান না । সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা সম অধিকারের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছি।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সাতক্ষীরার সাধারণ সম্পাদক জ্যোৎস্না দত্ত বলেন, ‘সাতক্ষীরায় আজও নারীরা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। একজন পুরুষের অর্ধেক মজুরি পান একজন নারী। নারী দিবস না হয়ে মানবিক দিবস হিসেবে পালন করলে সেটাই ভালো হয়। নারী-পুরুষ সবাই শ্রমিক কেন তাদের আলাদা করা হয়। সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানাই।’
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলা পরিষদের প্রাক্তন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মোসলেমা খাতুন বলেন, ‘সব ক্ষেত্রেই নারীরা অবহেলিত এবং বঞ্চিত। মুখে সবাই নারীর অধিকার নিয়ে বলে কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় উল্টো। সাতক্ষীরায় কর্মরত নারীদের দাবি আদায়ে সেইভাবে কোনও সংগঠন দেখা যায় না। নারীদের দাবি আদায়ে নেই ট্রেড ইউনিয়নও। আমিও নির্বাচিত এবং উপজেলা চেয়ারম্যানও নির্বাচিত। কিন্তু আমাদের সেইভাবে কাজ দেওয়া হয় না। নারীর অধিকার, নারী দিবস মুখে যতই বলি না কেন পুরুষশাসিত সমাজে এখনও পরিবর্তন আসেনি।’
সাতক্ষীরা জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম অফিসার ফাতেমা জোহরা বলেন, ‘আগে নারীদের মজুরি নিয়ে অনেক সমস্যা ছিল। আমাদের বিভিন্ন সচেতনামূলক কার্যক্রমের কারণে এটি অনেকাংশে কমেছে। এছাড়া নারীর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনিসহ সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার কাজ করে যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকার নারী অধিকার ও মজুরি বৈষম্য কমাতে আইন করেছে। সর্বনিম্ন মজুরি হবে ৪০০ টাকা। এখানে নারী-পুরুষ কোনও কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এর ফলে নারীর মজুরি বৈষম্য দূর হবে। নারীরা যেন তাদের নায্য মজুরি পায় সে বিষয়ে মালিক ও শ্রমিকদের সচেতন কার্যক্রম চলবে।’
পুরুষ শ্রমিকের মজুরি বেশি, তাই তাগো (তাদের) ছেড়ে দে আমাগো কাজে লাগিয়েছে। ধান ঝাড়ার (মাড়াই) কাজ পুরুষদের তুলনায় আমরা বরং বেশি করতি পারি। তা সত্ত্বেও পুরুষ মানুষকে ৩০০ টাকা দেওয়া হলেও আমাগো জন্যি বরাদ্দ মাত্র ২০০।’ কথাগুলো বলেন শ্যামনগর উপজেলার আবাদচণ্ডীপুর গ্রামের নারী সুমিত্রা মুণ্ডা। মেশিনে ধান মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত ত্রিশোর্ধ্ব বয়সী ওই গৃহবধূ আরও বলেন, ‘ধান কাটা, ঝাড়া ও তোলার কাজ শেষ হলি আমাগো একবেলার মজুরি দেবে দেড়শ।’ সকাল ৬টা থেকে তাঁদের কাজে যোগ দিতে হয় উল্লেখ করে তিনি জানান, তুলনামূলক বেশি খাটিয়ে নেওয়া হলেও মজুরির বিষয়ে তাঁরা বৈষম্যের শিকার।
উপজেলার জেলেখালী গ্রামের দুই সন্তানের জননী মানো লস্কর বলেন, ‘পুরুষ লোক একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আট কাবি (ধানের গোছ) রুতি (রোপণ করতে) পারে, আমরাও সেটা করি। অথচ তাগো সাড়ে ৩০০ দিলিও আমাগো মজুরি দেয় ২০০ টাকা।’ কখনও কখনও মালিক-মহাজন তার চেয়েও কম দিতে চায় জানিয়ে তিনি আরও বলেন, সমানতালে কাজ করা সত্ত্বেও শুধু নারী হওয়ার অজুহাতে তাঁদের সমান মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে প্রতিনিয়ত মহাজনের কাছে আর্জি জানিয়েও কোনো লাভ হয় না বলে তাঁর অভিযোগ।
শুধু আবাদচণ্ডীপুরের সুমিত্রা মুণ্ডা আর জেলেখালী গ্রামের মানো লস্কর নন, বরং মজুরির ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হওয়া নিয়ে এমন আক্ষেপ হরিপুর গ্রামের সুফিয়া খাতুন, মুন্সীগঞ্জের প্রমীলা রানীসহ উপকূলবর্তী শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন অংশের হাজারো শ্রমজীবী নারীর। অধিকাংশ কাজে পুরুষের তুলনায় বেশি সময় ও শ্রম দেওয়া সত্ত্বেও মজুরির ক্ষেত্রে তাঁরা বৈষম্যের শিকার।
ধুমঘাট গ্রামের কোনি মণ্ডল জানান, মাটি কাটা ছাড়া সব কাজে তাঁরা পুরুষের সঙ্গে রীতিমতো পাল্লা দিয়ে চলেন। অথচ মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় তাঁদের প্রতি বেলা একশ/দেড়শ টাকা কম দেওয়া হয়। অনেক সময় কম মজুরিতে পুরুষরা কাজ করতে সম্মত না হওয়ায় অর্ধেক মজুরিতে নারী শ্রমিকদের কাজে লাগানো হয় বলে জানান তিনি।
উপকূলবর্তী শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ, নুরনগর, বুড়িগোয়ালিনীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা সরেজমিন পরিদর্শনকালে স্থানীয় নারী শ্রমিকরা জানান, শুরু থেকেই তাঁরা এমন মজুরি বৈষম্যের শিকার। দীর্ঘদিনেও অবস্থার উন্নতি হয়নি দাবি করে তাঁরা বলেন, চারজন নারী শ্রমিক একবেলায় এক বিঘা জমির ধান মাড়াই করছেন। সমসংখ্যক পুরুষ একই সময়ে প্রায় সমপরিমাণ জমির ধান মাড়াই করলেও মজুরি দেওয়ার সময়ে তাঁদের জনপ্রতি ১০০ টাকা কম দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তোলা হলে অন্য শ্রমিক নেওয়ার হুমকি দিয়ে কম মজুরিতে তাঁদের কাজ করতে বাধ্য করছে।
উপকূলীয় এলাকার নারী শ্রমিকদের দাবি, কৃষিক্ষেত ও চিংড়িঘেরের পাশাপাশি নির্মাণ শিল্প, সড়ক সংস্কার, মাটি কাটাসহ অন্যান্য কাজে তাঁরা পুরুষের সঙ্গে সমানতালে শ্রম দেন। বিশ্রাম গ্রহণসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও তাঁরা তুলনামূলক কম নিয়ে থাকেন। তারপরও কায়িক শ্রমের এসব ক্ষেত্রে তাঁরা মজুরি বৈষম্যের শিকার।
নারী শ্রমিকদের জন্য স্থানীয়ভাবে নির্দিষ্ট কোনো সংগঠন গড়ে না ওঠায় তাঁদের মজুরি বৈষম্য দূর হচ্ছে না বলে অভিমত অনেকের। নারী শ্রমিকরা সংগঠিত না হওয়ার সুযোগ নিয়ে স্থানীয় মহাজনরা ইচ্ছামতো মজুরিতে তাঁদের কাজ করতে বাধ্য করছেন।
নারী শ্রমিকদের প্রতি মজুরি বৈষম্য নিয়ে শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুর রহিম জানান, এলাকায় কর্মসংস্থান সংকটের কারণে সবাই কাজের জন্য ঘুরছেন। এ সুযোগ নিয়ে স্থানীয়রা নারীদের দিয়ে পুরুষ শ্রমিকের কাজ করিয়ে তুলনামূলক কম মজুরি পরিশোধ করছেন। নারী শ্রমিকের প্রতি এমন মজুরি বৈষম্যের অবসানে সবার এগিয়ে আসার দাবি জানান তিনি।
অসহায় নারীদের নিয়ে কাজ করা উন্নয়ন সংগঠন ‘প্রেরণা’র নির্বাহী পরিচালক সম্পা গোস্বামী বলেন, এসব এলাকার নারীরা অনেক আগে থেকে মজুরি বৈষম্যের শিকার। তাঁদের সচেতন করার পাশাপাশি শ্রমজীবী নারীদের স্বার্থে একটি সংগঠন জরুরি বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট